শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভোটে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চান ইসি কর্মকর্তারা

আরপিও সংস্কারের প্রস্তাব, ৩১ জুলাই থেকে সংলাপ

গোলাম রাব্বানী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাইছেন নির্বাচন কমিশনের মাঠ কর্মকর্তারা। এ জন্য তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংস্কার আনার প্রস্তাব করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব বিষয় নিয়ে আগামী ৩১ জুলাই থেকে সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরপিও এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধি, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনবিধি, আচরণবিধিসহ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আইনে সংস্কারে এরই মধ্যে হাত দিয়েছে ইসি। এ লক্ষ্যে ৩১ জুলাই থেকে সংলাপ শুরু হচ্ছে। তার আগে ইসি ১০ আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে মতামত সংগ্রহ করেছে। আইন সংস্কার সংক্রান্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের কাছে এ সংক্রান্ত একীভূত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতামত সম্পর্কে জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পেতে মাঠ কর্মকর্তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অন্তত ৩৫টি অনুচ্ছেদে সংস্কার আনতে প্রস্তাব করেছেন। একইসঙ্গে তারা আমলাদের ভোটে আসতে নিষেধাজ্ঞা পাঁচ বছর করা, সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় আনা, প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়া, আচরণবিধি লঙ্ঘনে হাকিমদের মতো ক্ষমতা দেওয়া, জামানতের টাকা বাড়ানো, স্বশিক্ষিত হলেও সনদ দেওয়ার বিধান এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তদারকি করতে নির্বাচনী আইন সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। এর আগে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেছিলেন, ‘মাঠপর্যায়ের মতামতগুলো আমরা নিয়েছি। কারণ যারা এগুলো ফেস করে তারাই কিন্তু বলতে পারবেন কোন কোন জায়গায় সংস্কার দরকার। মতামতগুলোর যেটা যুক্তিসঙ্গত মনে হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ করবে, যুগোপযোগী করবে— শুধু সেই বিষয়গুলোকেই আমরা সিলেক্ট করব। রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সংলাপে বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরা হবে। তারপরে আমরা খসড়াটা চূড়ান্ত করব। তারপর আইন প্রণয়নের জন্য প্রপোজ করব।’  ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত মতগুলোতে বিভিন্ন প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি এসেছে। গত কমিশনের সময়ও কিছু প্রস্তাব ছিল তাও পেশ করা হবে বর্তমান ইসিতে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে ‘বিদ্যমান অবস্থান, প্রস্তাবিত সংশোধন ও পরিবর্তনের পক্ষে যৌক্তিকতা’ তুলে ধরে একীভূত সুপারিশ তৈরি করে সংস্কার কমিটির প্রধানের কাছে দেওয়া হয়েছে। আরপিওর পাশাপাশি অন্যান্য বিধির সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে ইসির নজরে আনা হবে। প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।  সেইসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দেওয়া হয়। তবে কয়েকটি এলাকায় জ্যেষ্ঠ  জেলা নির্বাচন অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন অফিসারকেও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়ার নজির রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার থাকলেও সংসদের উপনির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

যে সংস্কার চান কর্মকর্তারা : ১০ আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের মতামত অনুযায়ী, আরপিওর অনুচ্ছেদ ২-এ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ যুক্ত হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির নিরপেক্ষতা দৃশ্যমান হবে। এ ছাড়া স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ব্যক্তিগত ব্যয়ের সংজ্ঞাও স্পষ্ট করার প্রয়োজন বলে মত দেওয়া হয়েছে। স্বশিক্ষিত-এর নতুন সংজ্ঞায়নের প্রস্তাবের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামায় সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অনেক প্রার্থী স্বশিক্ষিত উল্লেখ করলে কোনো প্রকার সনদের কপি দেন না। বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োজিত থাকেন ভোটের সময়ে। ইসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে আইন সেলের মাধ্যমে ‘ইলেকটরাল ম্যাজিস্ট্রেট’ নাম দিয়ে তাদের নিয়োগ করা যায়। এতে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া যাবে।

অনুচ্ছেদ ৭-এ ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হবে তা উল্লেখ নেই। সরকারি কর্মকর্তা বা ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের জন্য এ অনুচ্ছেদের সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার জন্য ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ এবং কোনো ব্যক্তিকে দুই তা ততোধিক এলাকার জন্য নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিধানও করা হতে পারে। অনুচ্ছেদ ১২-এ সরকারি আমলাদের ভোটে অংশ নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা তিন বছর থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চাকরি থেকে বরখাস্ত, অপসারণ, অবসর বা পদতাগের ৫ বছর পর ভোটে অংশ নেওয়ার নিয়ম করলে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে চাকরিরত আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে মুক্ত রাখা যাবে। এই সঙ্গে ঋণখেলাপি-বিলখেলাপিদের অর্থ পরিশোধের শেষ সময় মনোনয়নপত্র জমার সাত দিন আগে না করে দাখিলের দিন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্য নির্বাচনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিধান রাখার পক্ষেও মত দেওয়া হয়েছে।  প্রস্তাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১% ভোটারের সমর্থনসূচক তালিকা দেওয়ার বিধান বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, যারা স্বাক্ষর দেন তাদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ভয়ে কাজ করেন। আবার অনেক ভোটার অর্থ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। আইনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট  দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সার্টিফিকেট না থাকলে মার্কশিট বা প্রশংসাপত্র দেওয়ার বিধান রাখা যেতে পারে।  অনুচ্ছেদ ১৩-এ প্রার্থীদের জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৪-এ মনোনয়ন দাখিল থেকে ভোট পর্যন্ত কেউ অসত্য তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৭-এ পোস্টাল ব্যালটের বিধান বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। যুক্তিতে বলা হয়েছে, এ বিধানটির কার্যকারিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই। তাই এটি বিলোপ করা যেতে পারে। অনুচ্ছেদ ৩৮-এ সমভোট প্রাপ্তদের মধ্যে বিজয় ঘোষণায় লটারি প্রথা বাতিল করে পুনঃভোট আয়োজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় দুই বা ততোধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোট সমান হলে এ আসনে পুনঃভোট করার বিধান করার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৪১-এ জামানত বাজেয়াপ্তে প্রচলিত কাস্টিং ভোটের এক অষ্টমাংশ থেকে বাড়িয়ে এক পঞ্চমাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৪৪-এ প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের ব্যয় তদারকিতে রিটার্নিং অফিসারের অধীনে একটি মনিটরিং কমিটি করা এবং অডিটে অপরাধ প্রমাণিত হলে পদ শূন্য ঘোষণার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল নির্ধারিত সময়ে ব্যয় বিবরণী দিতে ব্যর্থ হলে জরিমানা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৮৯-এ আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণে হাকিমদের পাশাপাশি ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৯১-এ নির্বাচনী পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের অনিয়ম ধরতে ‘তৃতীয় চোখ’ নিয়ে বিশেষ মনিটরিং টিম রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।  বিভিন্ন অনুচ্ছেদে আরও সংযোজন-বিয়োজন চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— নির্বাচনকালীন যানবাহন সংগ্রহের সুবিধার্থে ‘হুকুম দখলের’ ব্যপ্তি বাড়ানো,  জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তিন মাস আগে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার প্যানেল তৈরি, মনোনয়নপত্র জমার শেষ তারিখের কমপক্ষে একদিন পর বাছাইয়ের জন্য একাধিক তারিখ রাখা,  টিআইএন সনদ দাখিলে ১২ ডিজিট ব্যবহার, মনোনয়নপত্র বাতিল বা গ্রহণের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ থাকলেও বৈধ ঘোষিত বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতা বাড়ানো, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার বিষয়টি স্পষ্ট করা, ভোটের দিন বিভিন্ন ঘটনায় কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতার পাশাপাশি ভোটের আগে রাতে ব্যালট ছিনতাই-পরিস্থিতির অবনতি হলে কেন্দ্রের ভোট বাতিলের ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর