বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
বাহুবলে চার শিশু হত্যা

প্রধান আসামি খালাস ফাঁসি তিনজনের

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে আলোচিত চার শিশু হত্যা মামলায় তিন আসামিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত। মামলার অন্য দুই  আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং প্রধান আসামিসহ তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। গতকাল সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মকবুল আহসান এ রায় ঘোষণা করেন। ঘোষিত রায়ে মামলার বাদী এবং আসামি উভয় পক্ষই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও জানিয়েছেন। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা চার শিশু হত্যা মামলার রায় শুনতে গতকাল সকাল থেকেই সিলেটের আদালতপাড়ায় ছিল উত্সুক জনতার ভিড়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে মামলার কারান্তরীণ পাঁচ আসামিকে আদালতে আনা হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। রায়ে মামলার আসামি হাবিবুর রহমান আরজু (৪০), রুবেল মিয়া (১৮) ও উস্তার মিয়াকে (৪৮) ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত উস্তার মিয়া পলাতক রয়েছেন। এদিকে মামলার অন্য দুই আসামি শাহেদ ও জুয়েল মিয়াকে সাত বছর করে কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে আদালত। আলোচিত এ মামলার প্রধান আসামি আবদুল আলী বাগালসহ তিনজন খালাস পেয়েছেন। খালাসপ্রাপ্ত অন্য দুজন হচ্ছেন বাবুল মিয়া ও বিল্লাল মিয়া। সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘সিলেট বিভাগের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর মামলা ছিল এটি। চারটি নিষ্পাপ শিশুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা আদালতে ৫২ জন সাক্ষীর মাধ্যমে মামলাটিকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা আশা করেছিলাম, সব আসামির ফাঁসির আদেশ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রধান আসামিসহ তিনজনকেই খালাস দেওয়া হয়েছে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ এক প্রশ্নের জবাবে পিপি কিশোর কুমার কর বলেন, ‘মামলার প্রধান আসামি আবদুল আলী বাগালের বিরুদ্ধে আদালতে প্রচুর সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কেন তিনি খালাস পেলেন, এটা আমরা রায়ের কপি পাওয়ার পর বলতে পারব।’ সিলেট জেলা জজ কোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে চার আসামি সব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। আসামিরা বলেছেন, ঘটনার ২০-২৫ দিন আগে আবদুল আলী বাগালের নেতৃত্বে বৈঠক হয়। সে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারেই চার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তবু বাগাল কেন খালাস পেল, আমরা রায়ের কপি না দেখে বলতে পারছি না।’ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ লালা বলেন, ‘এরকম একটি চাঞ্চল্যকর ও নৃশংস হত্যা মামলা, যেখানে চার আসামি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। সব আসামির ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। কোনো অবস্থাতেই খালাসকে আমরা সমর্থন করি না। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।’ এদিকে, মামলার আট আসামির মধ্যে প্রধান আসামিসহ তিনজন খালাস পেলেও রায়ে সন্তুষ্ট নয় আসামিপক্ষ। আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম বলেন, ‘এ রায় ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে আমরা মনে করি। এ মামলায় যে চার আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাদের বক্তব্যে যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য থাকা দরকার, তা ছিল অনুপস্থিত। এ রায়ে আমরা মর্মাহত, সংক্ষুব্ধ। আমরা উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।’

২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিকালে নিখোঁজ হয় হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু জাকারিয়া আহমেদ শুভ, তাজেল মিয়া, মনির মিয়া ও ইসমাঈল হোসেন। নিখোঁজের পাঁচ দিন পর পার্শ্ববর্তী ইচাবিল নামক স্থান থেকে পুলিশ মাটিচাপা অবস্থায় তাদের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনার বাহুবল থানায় ৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন মনির মিয়ার বাবা আবদাল মিয়া। পুলিশ গ্রেফতার করে গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান আবদুল আলী বাগাল ও তার দুই ছেলেসহ ছয়জনকে। এর মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত বাচ্চু র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। আবদুল আলীর দুই ছেলে রুবেল মিয়া ও জুয়েল মিয়া এবং আরজু মিয়া ও শাহেদ মিয়া হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। মামলার আসামি উস্তার মিয়া, বাবুল মিয়া ও বিল্লাল মিয়া পলাতক রয়েছেন। তবে গতকাল রায়ে বাবুল ও বিল্লাল খালাস পেয়েছেন। গত বছরের ২৯ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির তৎকালীন ওসি মোক্তাদির হোসেন ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরে ৭ সেপ্টেম্বর মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ১৫ মার্চ মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। মামলার মোট ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৪৫ জন এবং সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। গত ২০ জুলাই মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। পুলিশ ও আসামিদের জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, সুন্দ্রাটিকি গ্রামের দুই মুরব্বি আবদাল মিয়া ও আবদুল আলী বাগালের মধ্যে পারিবারিক বিরোধের জেরে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

সর্বশেষ খবর