রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছোট ঋণে বড় অনিয়ম!

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

উত্তরাঞ্চলে গরিবি হটাতে বিশেষ ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)-কে। এই সুযোগে রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা মিলে নামে-বেনামে ভুয়া ঋণগ্রহীতা তৈরি করেন। তারপর ঋণগ্রহীতাদের নামে দেওয়া ৫৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা কোনো জামানত ছাড়াই এই ঋণ দিয়েছিলেন। এখন ঋণ আদায় দূরের কথা, ঋণ গ্রহীতাদেরই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর ব্যাংকটির কাছে জানতে চান, ঋণ প্রদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? জবাবে রাকাবের এমডি জানান, জড়িত চার কর্মকর্তার মধ্যে ৭০ শতাংশ অর্থ দুজনের বেতন হতে কেটে নেওয়া হচ্ছে। বাকি দুজনকে আদালত অব্যাহতি দিয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া ছোট ছোট এ ধরনের ব্যাংক ঋণেও এখন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ধরা পড়ছে। এতে করে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় বড় ঋণের বাইরে ছোট ঋণ দেদার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি এক সভায় ছোট আকারের ঋণে অনিয়ম ও অডিট আপত্তি পর্যালোচনা করে। জাতীয় সংসদ থেকে গত ৯ জুলাই ওই সভার কার্যবিবরণী অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

এই কমিটি যে ধরনের ঋণের অনিয়ম নিয়ে আলোচনা করেছে, সেখানে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এ ধরনের অন্তত ৯১টি অনিয়মের বিপরীতে প্রায় ১১৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকার অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করা হয়। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিভিন্ন কারণে ছোট আকারের ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বড় অঙ্কের ঋণের পাশাপাশি এখন ছোট ছোট ঋণেও নানারকম অনিয়ম দেখা যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া ঋণ সবচেয়ে বেশি খেলাপি হয়। আবার ঋণগ্রহীতা বিভিন্ন কারণে ঋণের টাকা প্রকল্প থেকে সরিয়ে ফেললেও পরে তা আর পরিশোধ করতে পারেন না। অনেক সময় পারিপার্শ্বিক সমস্যার কারণেও ছোট আকারের ঋণ খেলাপি হয়ে যায় যা ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতিকর। সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভার কার্যবিবরণীতে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশ অমান্য করে শাখা কর্মকর্তাদের ঋণ প্রদান; প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া; ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে চলতি হিসাবে টাকা না থাকা সত্ত্বেও ঋণ প্রদান করা এবং প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই সীমার অতিরিক্ত ঋণ প্রদান করার মতো নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। নিচে কয়েকটি অনিয়ম তুলে ধরা হলো।

সীমার অতিরিক্ত ঋণ : একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে মেসার্স নিদ্রা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড নামে কোম্পানিকে সিসি (হাইপো) ঋণের সীমার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করা হয়। কর্মকর্তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এই অনিয়ম করেন। পরে সময় মতো ঋণ পরিশোধ না করায় ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের ক্ষতি হয় প্রায় ৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। বর্তমানে এই ঋণের ওপর অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ঋণ দাতা ব্যাংকের এমডি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বলেন, অনাদায়ী টাকা আদায়ের জন্য মামলা চলছে। ৩৩/৭ ধারায় জামানতকৃত সম্পত্তির মালিকানা পেলেও নামজারি হয়নি। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬০ দিনের মধ্যে এ ধরনের ঋণ প্রদানে সহায়তাকারী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের মাধ্যমে যাতে স্থায়ী কমিটিকে অবহিত করা হয়।

মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ : কোনো ধরনের জামানত রেজিস্টার্ড মর্টগেজ ছাড়াই একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি ৫১ লাখ টাকা ঋণ দেয় একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা। এখন ওই ঋণ আদায় করতে না পারায় সুদে-আসলে ব্যাংকটির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ নিয়ে এখন ব্যাংকটির বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি উঠেছে। শেষে সভায় সিদ্ধান্ত হয় : রেজিস্টার্ড মর্টগেজ ছাড়াই ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা ঋণ দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন কি যারা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাত্ক্ষণিক বিষয়গুলো পরীবিক্ষণ করে ব্যবস্থা নেবে।

চলতি হিসাবে টাকা ছাড়াই ঋণ : মেসার্স ইন্টার লিংক সেন্টার লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইন্টারলিংক পিএলসি লিমিটেডের চলতি হিসাবে টাকা না থাকা সত্ত্বেও ঋণ দিয়ে দেয় একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। পরে ওই ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ না করায় ব্যাংকটির প্রায় ২ কোটি ২২ লাখ ৯১ হাজার টাকা ক্ষতি হয়। অনাদায়ী টাকা আদায়ের জন্য এখন প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর