মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

নির্বাচনের আগে সচিবদের ২৬ নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

নির্বাচনের আগের বছর জনপ্রশাসনকে আরও বেশি জনবান্ধব ও সক্রিয় করতে সচিবদের উদ্দেশে ২৬টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব নির্দেশনায় জনগণের ভোগান্তি কমানো, দুর্নীতি প্রতিরোধ, জঙ্গি দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষিজমি রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সামাজিক বনায়ন থেকে শুরু করে উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন, দুর্যোগ প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, প্রশাসনের আন্তবৈষম দূর করা, এমনকি আদালতে সরকারি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মামলায় জয়ের জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২ জুলাই অনুষ্ঠিত সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এ-সংক্রান্ত চিঠি সচিবদের কাছে পাঠান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন এর মূল  বিষয়বস্তু হচ্ছে, একটি সক্রিয় ও জনবান্ধব প্রশাসন এবং দেশের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি অঞ্চলভিত্তিক এমন সব প্রকল্প গ্রহণ করতে বলেছেন, যাতে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়। সচিবদের বলা হয়েছে, দেশের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন সেবাদাতা সংস্থাগুলোকে এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে জনগণের ভোগান্তি হ্রাস পায়। আর জনপ্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ করুন। সরকারি কর্মচারী হিসেবে নয়, দেশপ্রেমিক নাগরিক ও জনগণের সেবক হিসেবে জনকল্যাণে আত্মনিয়োগে সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করুন।’ এ ধরনের নির্দেশনার ক্ষেত্রে সামনের বছরের জাতীয় নির্বাচনের ইস্যুটি প্রভাব রেখেছে কি না এমন প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না।

চিঠিতে উল্লিখিত প্রধানমন্ত্রীর ২৬ নির্দেশনা : রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর পরিচালনার জন্য কাস্টমস ও ব্যাংকিং কার্যক্রম সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকাসহ অন্যান্য পাহাড় ও টিলা-অধ্যুষিত এলাকার পরিবেশ রক্ষা, ভূমিধস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালনে আরও আন্তরিক হতে হবে, যেন এ বছরের মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ ধরনের জরুরি দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। রাস্তাঘাট নির্মাণের সময় প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ ও রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষরোপণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন, সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, যাতে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম তিন মাস প্রকল্পের পেপারওয়ার্ক সম্পন্ন করে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে কাজের গুণগত মানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বাজেট প্রাপ্তির পরপরই অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প বাছাইপূর্বক তা বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্ত করা যায়। প্রকল্প প্রণয়নে ব্যাংক সুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর’ নির্ধারণ করা যেতে পারে। পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্পের মালামাল পরিবহনে আন্তদেশীয় সমস্যার বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে দ্রুততার সঙ্গে অবহিত করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার আরও বাড়াতে হবে। অর্থবছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়া না করে বছরের শুরু থেকেই বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের সেবা ও শুদ্ধাচার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। সেবাদাতা সংস্থাগুলো থেকে সেবা পেতে জনগণের ভোগান্তি হ্রাস করতে হবে। জনপ্রশাসনের ক্ষোভ দূর করার বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সচিবদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করে সবার ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতি ও পদায়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি এবং সংসদ পরিচালনা-সংক্রান্ত কার্যক্রমের বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। জঙ্গিবাদ দমন এবং মাদক নিয়ন্ত্রণেও মাঠপর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও এসডিজির সফল বাস্তবায়নে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তিনি। কৃষিজমি নষ্ট না করে এলাকাভিত্তিক ঘোষিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়েছেন।

 ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ও ২০০৯ থেকে বর্তমান মেয়াদ পর্যন্ত সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের তালিকা প্রস্তুত এবং প্রামাণ্যচিত্র আকারে তা তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আদালতে বিচারাধীন সরকারি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনার জন্য বর্তমান ব্যবস্থার পাশাপাশি অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে এবং মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া যেসব জেলা নিজ উদ্যোগে তহবিল গঠন করে ভিক্ষুকমুক্ত করার পদক্ষেপ নেবে, সেই তহবিলে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর