বুধবার, ২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় : ফিরল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক

১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থী

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তি ও বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত ক্ষমতা সংবিধানের পরিপন্থী। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি এ অভিমত দেন।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল করেছে সর্বোচ্চ আদালত। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরেছে সংবিধানে।

রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘এ রায়ের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপিত। অর্থাত্ বিচারককে অপসারণের প্রয়োজন হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে করা হবে।’ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেন, ‘এ রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে।’

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রধান বিচারপতির মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের দুই সদস্য বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। তবে প্রধান বিচারপতির ওই মতামতের সঙ্গে একমত হতে ‘অক্ষমতা’ প্রকাশ করেছেন বেঞ্চের আরেক সদস্য বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ মামলার বিষয়বস্তু না হওয়ায় ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকার কথা উল্লেখ করে বেঞ্চের দুই সদস্য বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, এ ক্ষেত্রে অন্য ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেন, চতুর্থ সংশোধনীতে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’-এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হয়েছে। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন এবং ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দের প্রতিস্থাপন সংবিধান পরিপন্থী।

উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ঐকমত্যের ভিত্তিতে খারিজ হয়। ৭ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন। কিছু পর্যবেক্ষণসহ সর্বসম্মতভাবে আপিল খারিজ করা হয়। গতকাল সেই রায়ের ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। এ রায় পাওয়া যায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও।

এদিকে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিলের রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় অনুচ্ছেদ ১১৬ সম্পর্কে বলেছেন, এটি সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন, সেখানে এটি পেলাম না।’ নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের ভিতরে যা-ই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে কী বলা আছে সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট যেটি, সেখানে কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি বলব, এটি একজন বিচারপতির অভিমত হতে পারে। কিন্তু রায়ের শেষাংশে, যেটিকে আমরা অর্ডার অব দ্য কোর্ট বলি, সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়েছে বলে ধরা যায় না।’ মাহবুবে আলম বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদকে যদি বাতিল করতে হতো, তাহলে সবাইকে সেখানে স্বাক্ষর করতে হতো। অর্ডার অব দ্য কোর্ট তা-ই হতো। অ্যাটর্নি জেনারেল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ এ মামলার ইস্যু ছিল না, ইস্যু ছিল ৯৬ অনুচ্ছেদ। ইস্যু না থাকলেও রায়ে বিষয়টি আসতে পারে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি উচিত নয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হয়েছে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, ‘আমার একটি দুঃখ হচ্ছে, এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হচ্ছে পাকিস্তান, মার্শাল ল’ ও জিয়াউর রহমানের ব্যবস্থা। তাই এর পুনঃস্থাপনে আমি ব্যথিত হয়েছি।’ তিনি বলেন, এ রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন জানানো হবে কি না তা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। উল্লেখ্য, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে।

উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দেয়। সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর আসাদুজ্জামান সিদ্দিকীসহ সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাই কোর্টে একটি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে ষোড়শ সংশোধনী কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাই কোর্ট। রুলের শুনানি শেষে হাই কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। তিন বিচারপতির ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। হাই কোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিলের শুনানিতে ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য গ্রহণ করে আদালত। এর মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মত দেন বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ফিদা এম কামাল, এ এফ হাসান আরিফ, এম আই ফারুকী এবং এ জে মোহাম্মদ আলী। তবে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মত দেন শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি। আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করলেও বাকি দুজন মতামত দেননি। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকলেও ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না। ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দফা (২)-এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

মন্ত্রী এজলাসের কথা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, এটা কি ফেয়ার : প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, কিছু মন্ত্রী এজলাসে বসে কথা বলার বিষয়ে মন্তব্য করেন। এটা কি ফেয়ার? নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে গতকাল প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগে এ কথা বলেন। গতকাল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ওই মন্তব্য করার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, দুই দিক থেকে বক্তব্য আসে। বক্তব্য মিডিয়া লুফে নেয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, এ কথা বলছেন কেন? বিচারে আমরা রাজনৈতিক মন্তব্য দেই না। বিচার বিভাগ সংক্রান্ত বক্তব্য দেই। বিচার বিভাগে যখন যে ইস্যু চলে আসে। যেমন আজকে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্পর্কে। না বললে কি থাকল? মাসদার হোসেন মামলা। আমরা রাজনৈতিক কথা বলছি না। এ সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, শৃঙ্খলা বিধির খসড়ায় গেজেট প্রকাশের বিষয়টি আমরা সুপ্রিম কোর্টের কথা অনুসারে বলেছিলাম। কিন্তু আপনারা সেখানে সরকারের কথা বলেছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজনৈতিক কথা বলছি না। কিছু কিছু মন্ত্রী, মি. অ্যাটর্নি জেনারেল, আপনারা বিচারপতিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। পত্রিকায় এসেছে, একজন, একজন বলেছেন। কোর্ট প্রসিডিংসে, আদালতের কার্যক্রমে যা হয়, তা নিয়ে সংসদ ও পাবলিকলি কথা বলার সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের ‘ক’ এর ব্যাখ্যা দিয়ে মাসদার হোসেন মামলার রায় হয়েছে। এখন যদি আপনার কাছ থেকে ব্যাখ্যা শুনতে হয়, তাহলে দুঃখজনক। প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, আপনারা প্রধান বিচারপতি ও কোর্টের স্বাধীনতা খর্ব করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কি কিছুই বলতে পারব না? আমরা কি কোর্টে বসে মন্তব্য করতে পারব না? শুনানিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় আরও দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে আপিল বিভাগ। ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুযোগ আরও দুই সপ্তাহ থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

সর্বশেষ খবর