শিরোনাম
বুধবার, ২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কয়েক দফা হত্যার ষড়যন্ত্র ১৫ আগস্টের আগেও

ষড়যন্ত্র কতদূর বিস্তৃত ছিল সে সম্পর্কে অনেক তথ্য এখনো অজানা

জুলকার নাইন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেই কয়েকদফায় হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা তখন বিভিন্নভাবে শোনাও গিয়েছিল। কিন্তু কেউ তেমনভাবে একে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। আবার কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের তথ্য গোপনও করা হয়েছিল। ১৯৭৫-এর আগস্টের আগেই তাদের কারও কারও পরিচয় প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে ছিল নিষ্ক্রিয়তা। সেই সময়কার বিভিন্ন স্মৃতিকথা, সাক্ষাৎকার ও ইতিহাসের বইয়ে এমন বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। এ নিয়ে গবেষণাধর্মী একাধিক নিবন্ধ রচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাদির জুনায়েদ। তার মতে, এই ষড়যন্ত্র কতদূর বিস্তৃত ছিল সে সম্পর্কে অনেক তথ্য এখনো অজানা। আরও গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে হয়তো আগামীতে এই বিষয়ে নতুন তথ্য জানা সম্ভব হবে। এস মাহমুদ আলী তার ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, ‘ঢাকায় ১৯৭৪ সালের শেষভাগ থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এবং সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব শোনা যাচ্ছিল (মাহমুদ আলী: ২০১০, পৃ-১১০।) সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলত্জ ১৯৭৯ সালে ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানে তার একটি লেখায় উল্লেখ করেন যে, ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে কিছু বাংলাদেশি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উত্খাতের ব্যাপারে কথা বলেন। লিফসুলত্জ এই বাংলাদেশিদের পরিচয় প্রকাশ করেননি। তবে বঙ্গবন্ধুকে উত্খাতের ষড়যন্ত্রে খন্দকার মোশতাক জড়িত থাকা প্রসঙ্গে লিফসুলত্জ এই বৈঠকসমূহের কথা উল্লেখ করেন। তার লেখায় তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এই বাংলাদেশিরা কোনো সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের প্রধান দুই পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কোনো বিদেশি মিশনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছিলেন। অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের বই ‘বাংলাদেশ : এ লিগাসি অব ব্লাড’ বইয়ে লিখেছেন, মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগকারী বেসামরিক ব্যক্তিরা বেশ কবার অনানুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে মার্কিনিরা এই বাংলাদেশিদের সঙ্গে আর আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ধারণা করা হয়, এই বাংলাদেশিরা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উত্খাত করার ব্যাপারে মার্কিন মনোভাব বোঝার ব্যাপারেই মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। মার্কিনিরা এই বাংলাদেশিদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করেছিল কি না তা জানা যায়নি। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই গোপন বৈঠক সম্পর্কে কতটুকু তথ্য পেয়েছিল তাও জানা যায়নি। (পৃষ্ঠা-৬৫)। ‘কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের নীলুফার হুদা লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৭৫ সালে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেইসময়ের একমাত্র আর্মড রেজিমেন্ট বেঙ্গল ল্যান্সারসে্র সহ-অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র অল্প কিছুদিন আগে ফারুক মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে কলকাতায় আসেন। যশোর মুক্ত হওয়ার পর ফারুক যশোরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। (পৃ-১০৬।) ‘গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ শীর্ষক বইয়ে মেজর নাসির উদ্দিন লিখেছেন, যুদ্ধের পর তাকে (ফারুক) নবগঠিত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ট্যাংক কোরের অফিসার ফারুক কিছুদিন পর ঢাকায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর একমাত্র ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারসে্ অধিনায়ক পদে বদলি হয়ে আসেন। অচিরেই তিনি সেনাবাহিনীতে রুশ-ভারত বলয়ের সমালোচনাকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মনোভাবটিও স্পষ্ট হতে থাকে (পৃ-৫০)। ড. নাদির জুনায়েদের নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় ফারুক সরকার উত্খাতের ব্যাপারে তার এবং সেনাবাহিনীর অন্যান্য কিছু জুনিয়র অফিসারের চিন্তার কথা সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রকাশ করেন। লক্ষণীয়, ফারুক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা না করে জিয়াকে আস্থায় নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। সরকার পরিবর্তনের এই পরিকল্পনায় ফারুক জিয়ার সমর্থন এবং নেতৃত্ব চান। এস মাহমুদ আলী তার ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের ১১১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৯৭৫-এর মার্চে তার অধীনস্থ সেনা কর্মকর্তা ফারুকের কাছ থেকে এমন একটি পরিকল্পনার কথা শোনার পরও সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়া ফারুককে নিবৃত্ত বা গ্রেফতার করার চেষ্টা করেননি। ঘটনাক্রম অনুসারে, ১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিজিএস। মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন মাস পর তার নেতৃত্বেই ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর ট্যাংক কোরের অপর একজন অফিসার মেজর নাসির উদ্দিনের এক বর্ণনা থেকে জানা যায় খালেদ মোশাররফ ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকেই ফারুকের সরকার বিরোধী অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনার ব্যাপারে অবহিত হয়েছিলেন। মেজর নাসির উদ্দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ট্যাংক কোরের অফিসার হিসেবে তিনিও বেঙ্গল ল্যান্সারসে্ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীর সদর দফতরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ‘গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ শীর্ষক বইয়ের পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯ এ মেজর নাসির উদ্দিন লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া তিনটি পুরনো এবং হালকা ধরনের মার্কিন এম-২৪ শেফি ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস্ যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত ৩০টি টি-৫৪ মিডিয়াম ট্যাংক উপহার দেন। ট্যাংকগুলোর সঙ্গে শচারেক গোলাও বাংলাদেশ পাঠানো হয়। ১৯৭৫-এর মার্চ মাসের মাঝামাঝি কোনো এক রাতে গোলাসহ ৬টি ট্যাংক বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জীবন্ত গোলা বর্ষণ মহড়ার জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। মেজর ফারুকের ওপর দায়িত্ব ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্যাংকগুলো বিশেষ ট্রেনে তুলে দেওয়ার কাজটি তদারকি করা। ফারুক গভীর রাতে মেজর নাসিরের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাকে জানান যে তিনি ট্যাংক ট্রেনে না তুলে সেই রাতেই একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে চান। নাসিরকে তার প্রয়োজন কারণ বেঙ্গল ল্যান্সারসে্ চারশোর মতো মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক আছে যারা নাসিরের নির্দেশ মেনে নেবে। নাসির ফারুকের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ফারুকের উপস্থিতিতেই টেলিফোন করেন। খালেদ ফারুকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাকে নিবৃত্ত করেন এবং নাসিরকে নির্দেশ দেন ফারুকের সঙ্গে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে ট্যাংক ট্রেনে তোলা তদারক করার জন্য। খালেদ এও জানান, ফারুক অন্যরকম কিছু করলে তাকে গ্রেফতারের জন্য তিনি মিলিটারি পুলিশ পাঠাবেন। ড. নাদির জুনায়েদের মতে, সেই রাতে ফারুকের এমন আচরণ দেখার পরও ফারুকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ বা মেজর নাসির কেউই সরকার, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ বা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ফারুকের এমন পরিকল্পনার কথা আদৌ জানিয়েছিলেন কি না তা জানা যায় না। কর্নেল শাফায়াত জামিল তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইয়ের পৃষ্ঠা ১১৭তে লিখেছেন, ঢাকা সেনানিবাসে আগে থেকেই একথা জানা ছিল যে, ফারুক ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর তখনকার তিনটি ট্যাংক নিয়ে একবার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তার সমর্থনে কুমিল্লা থেকে একটি সৈন্যদল ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই দলটি ঢাকায় এসে না পৌঁছায় ফারুকের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ড. নাদির জুনায়েদের মতে, ট্যাংক ব্যবহার করে একটি অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে ফারুকের এমন আগ্রহ এবং তত্পরতা সম্পর্কে সেনাবাহিনীর সব ঊর্ধ্বতন অফিসার অবহিত থাকার পরও তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং ফারুক সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারসে্ সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এই রেজিমেন্টের ট্যাংকগুলোর সাহায্যেই তার ভয়াল এবং নির্মম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন যার ফলে প্রাণ হারান শেখ মুজিবসহ আরও অনেকে।

সর্বশেষ খবর