বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
সেই ঢাকা এই ঢাকা

কোথায় গেল আমাদের ধোলাইখাল

ইমদাদুল হক মিলন

কোথায় গেল আমাদের ধোলাইখাল

আমার ছেলেবেলার কয়েকটা বছর কেটেছে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার এলাকায়। আমার মায়ের একমাত্র মামার বাড়ি গেন্ডারিয়াতে। কখনো কখনো জিন্দাবাহার থেকে গেন্ডারিয়ায় সেই নানার বাড়িতে যেতাম। সূত্রাপুর এলাকায় এলেই অন্যরকম এক রোমাঞ্চে শরীর ভরে যেত। সেখানে বিস্তীর্ণ ধোলাইখালের ওপর লোহারপুল। আমরা রিকশা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে লোহারপুল পার হতাম। রিকশাওয়ালা অতি কষ্টে রিকশা টেনে টেনে তুলত। একষট্টি বাষট্টি সালের কথা। লোহারপুলে উঠেই রেলিং ধরে দাঁড়াতাম। ধোলাইখালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, উত্তরে ধনুকের মতো বেঁকে ঢাকার নানাদিকে ছড়িয়ে গেছে ধোলাইখালের শাখা-প্রশাখা। কত চওড়া খাল, কী স্বচ্ছ পানি, কতরকমের নৌকা যাচ্ছে-আসছে। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগত।

বাংলা সাহিত্যের অমর লেখক সমরেশ বসুর ‘কোথায় পাবো তারে’ উপন্যাসে ধোলাইখালের অপূর্ব বর্ণনা আছে। ‘কালকূট’ ছদ্মনামে এই উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। আমার ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসে আছে ষাটের দশকের শুরুর দিককার ধোলাইখালের বর্ণনা।

কোথায় হারিয়ে গেছে সেই খাল! চৌষট্টি সাল থেকে গেন্ডারিয়ায় ছিলাম একটানা পঁয়ত্রিশ বছর। লোহারপুল, কাঠেরপুল পার হয়ে কলেজে যেতাম, ইউনিভার্সিটিতে যেতাম। দয়াগঞ্জের ওদিক দিয়ে রেলপুল পার হয়ে যেতাম গুলিস্তানের দিকে। তখনো কত চওড়া ধোলাইখাল। টলটলে পরিষ্কার পানি। বর্ষায় ধোলাইখাল হয়ে যেত প্রায় নদী। আমরা কয়েক বন্ধু কলুটোলা কাঠের পুলের ওপর থেকে খালের পানিতে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তাম। ধোলাইখালের এপার থেকে ওপার সাঁতরে যেতে জান বেরিয়ে যেত। আমার দুরন্ত বালকবেলার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে ধোলাইখাল।

কোথায় হারিয়ে গেছে সেই খাল! কালের কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় আমি একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি। উপন্যাসের নাম ‘পিছন’। ১৯৬৪ সাল থেকে ৭০ সালের শেষ পর্যন্ত সময়কাল নিয়ে লেখা। এই উপন্যাসেও আছে ধোলাইখালের কথা, ধোলাইখালের বর্ণনা। যে ধোলাইখালের শাখা-প্রশাখা ঢাকা শহরের নানা দিক দিয়ে ঢুকে গিয়েছিল, যে ধোলাইখাল বহন করত বর্ষায় বৃষ্টিতে উপচে পড়া পানি, সেই পানি নিয়ে ফেলত বুড়িগঙ্গায়। কারা মারল এই মহান খালটিকে? কেন মারল?

ধোলাইখালের অস্তিত্ব এখন আর নেই। লোহারপুল, কাঠেরপুল নেই। ধোলাইখাল এখন পাকা রাস্তা। তার তলায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ময়লা আবর্জনায় বছরের পর বছর ধরে তলদেশের নিষ্কাশন ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে আছে। ঢাকার খালগুলো নানারকমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। আমরাই মেরেছি খালগুলো, আমরাই দখল করেছি। সরু ড্রেনের মতো যা-ও বা বেঁচে আছে কোনো কোনো খাল, সেগুলো পরিণত হয়েছে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে। ঢাকা একদা খুবই আধুনিক শহর ছিল। ইউরোপের কোনো কোনো বিখ্যাত শহরের মতো ঢাকার বুকের ভিতর দিয়ে যে খালগুলো প্রবাহিত হতো সেই প্রবাহের ফলে ঢাকায় আমরা কখনো জলাবদ্ধতা দেখিনি। আর আজ? এখন? এবারের বৃষ্টিতে যে অবস্থা ঢাকায় আমরা দেখেছি, ঢাকার পুরনো দিনের মানুষ কখনো এই অবস্থা কল্পনা করেনি। ঢাকাকে আধুনিক করার নামে শহরটির আসলে সর্বনাশই করেছি আমরা। নদী খাল দখল করে ধ্বংস করেছি আমাদের প্রিয় শহর। এই শহরকে এখন আমরা কেমন করে বাঁচাব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জলাবদ্ধ ঢাকা শহর নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন এবং তার সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন কীভাবে এই শহরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করবেন, কীভাবে উদ্ধার করবেন দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো। বক্স কালভার্ট অপসারণ করে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেই দিক নির্দেশনাও তিনি দিয়েছেন। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে ব্যাপকভাবে খনন করে নদীর প্রবাহমানতা বাড়াবার জন্য যে উদ্যোগ তিনি নিতে যাচ্ছেন তা এক কথায় অসাধারণ। তিনি বাংলাদেশের চেহারা অনেকখানি ঘুরিয়ে দিয়েছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেশের ইতিহাসে যুক্ত করছেন কয়েকটি সোনালি পাতা। তার পরিকল্পনায় নিশ্চয়ই ঘুরে যাবে ঢাকার আজকের চেহারা। ঢাকা হয়ে উঠবে স্বপ্নের শহর, ঢাকা হয়ে উঠবে পাশ্চাত্যের আধুনিক নগরীগুলোর মতো। ঢাকার খাল এবং জলাধারে টলটল করবে স্বচ্ছ পানি। বর্ষায় বৃষ্টিতে স্রোতের মতো পানি নেমে যাবে চারপাশের নদীতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার ভাবনা আমাদের এই স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আপনার পরিকল্পনা মতো ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করা গেলে আপনার প্রতি বাঙালি জাতির কৃতজ্ঞতা আরও বাড়বে। আমরা আপনার মুখ চেয়ে আছি।

সর্বশেষ খবর