শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন

দুই চীনা জুয়াড়ির বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির তথ্য

প্রতিদিন ডেস্ক

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত দুই চীনা নাগরিকের পরিচয়সহ সেই চুরির বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধানে তুলে এনেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। গতকাল অনলাইনে প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে তারা বলেছে, অর্থনীতিতে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম সাইবার ক্রাইমে বাংলাদেশ যে ৮১ মিলিয়ন ডলারের অর্থ হারায় তার অন্যতম হোতা চীনা নাগরিক ডিং এবং গাও শুহুয়া। দুজনকেই ইতিমধ্যে চীনা কর্তৃপক্ষ গ্রেফতার করেছে। ২০১৬ সালের আগস্টে গাও এবং গত মার্চ মাসে ডিং চীনা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকের কথা। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার ক্যাসিনো সোলারির একটি ভিআইপি কক্ষে ‘ব্যাকারার্ট’ (তাসের জুয়া) খেলছেন চীনা জুয়াড়ি ডিং, তার পার্টনার গাও শুহুয়া ও আরও কয়েকজন সঙ্গী। ভিআইপি অতিথিদের জন্য কিছুক্ষণ পরপর আসছে মিনারেল ওয়াটার, লেমন চা, ফরাসি মদ ইত্যাদি। যে ছোট ছোট চৌকোণা পাতলা চিপগুলো দিয়ে তারা বাজি ধরছেন তার কার্যকারিতা কেবল ওই কক্ষটিতেই। একেকটা চিপের দাম ২০ হাজার মার্কিন ডলার। আসলে খেলাটা ছিল পাতানো এবং খেলায় মগ্ন এই জুয়াড়িদের লক্ষ্য কিন্তু অর্থ উপার্জন নয়, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা ডলার জুয়া খেলার ছলে ভাগাভাগি করা। ফিলিফাইনের সরকারি তদন্ত দলে গত বছর পর্যন্ত সদস্য ছিলেন সের্গিও ওসমেনা ঈল। তিনি ব্লুমবার্গকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থের মতোই ডিং ও গাও ফিলিফাইন থেকে কোনো সূত্র না রেখে হাওয়া হয়ে যান। ফিলিফাইনস কাস্টমসের কাছে তাদের দেশত্যাগের কোনো সূত্র নেই। তাই বাংলাদেশ, ফিলিপাইন বা যুক্তরাষ্ট্রের কারোরই বাকি অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে করে না ব্লুমবার্গ। বিশ্বের অন্যতম বড় জুয়ার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা ম্যাকাওতে বর্তমানে ৪৫ বছর বয়সী ডিং ২০০৭ সালে একটি বিনিয়োগ কোম্পানি খোলেন। এলাকার বাসিন্দারা জানান, মূল ভূখণ্ডে জুয়া নিষিদ্ধ থাকায় এ সময ডিং মূল ভূখণ্ড থেকে বড় বড় জুয়াড়িদের এনে এখানে ক্যাসিনোতে জড়ো করতেন। জুয়ার অবৈধ আসর থেকে ডিং কী পরিমাণ অর্থ আয় করেছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০০৮ সালে তিনি ওই এলাকায় রিয়েল স্টেট ব্যবসায় ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন। সেখান থেকে গাড়িতে আধাঘণ্টার দূরত্বে তিনি চারতলা বিলাসবহুল একটি বাড়ি করেছেন যার মূল্য ৫০ লাখ ডলার। পুলিশের তথ্যমতে, ডিংয়ের বাড়িতে একবার চুরি হয়েছিল। তখন ৬ লাখ ডলারের মালামাল খোয়া যায়। এ থেকেই নামে-বেনামে তার সম্পদের পরিমাণের একটি আন্দাজ পাওয়া যায়। অন্যদিকে বর্তমানে ৫৩ বছর বয়সী গাও বড় হন পেইচিংয়ে। শহরের অন্যতম ধনী তিনি। আদালত ও পুলিশ সূত্র মতে, ২০০৪ সাল থেকে তিনি সেখানে একটি ক্যাসিনো চালিয়ে আসছেন। তিনি জেলও খেটেছেন। ২০০৬ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গাও ম্যাকাও ও ফিলিফাইনে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন। ফিলিফাইনে ২৯টি জায়গায় তিনি ক্যাসিনো নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। এবং প্রায় কোটি ডলারের মালিক হন। হংকংয়ের পুলিশ বাহিনীর অপরাধ গোয়েন্দা ব্যুরোর সাবেক প্রধান স্টিভ ভিকারেস বলেন, ‘ডিং ও গাও দুজনেই ম্যাকাওতে প্রসিদ্ধ। এ দুজন এখন উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের কাজে লাগতে পারেন। ওসমেনার মনে করেন, ডিং ও গাও চুরি করা অর্থ সম্ভবত উত্তর কোরিয়ায় তাদের সিন্ডিকেটের কারও কাছে পাঠিয়ে দিয়ে থাকতে পারেন। ঘটনার পর এ পর্যন্ত ফিলিফাইন কর্তৃপক্ষ চুরি হওয়া ওই অর্থের এক-পঞ্চমাংশ উদ্ধার করে বাংলাদেশকে ফেরত দিয়েছে। কিন্তু বাকি অর্থের বেশির ভাগই মানি-ট্রান্সফার কোম্পানি, ক্যাসিনো ইত্যাদির মাধ্যমে হাওয়া হয়ে যায়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তা জানান, বাকি অর্থ হয়তো উত্তর কোরিয়ায় পাওয়া যেতে পারে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

অনলাইন সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর মতে, উত্তর কোরিয়ার ল্যাজারাস হ্যাকার গোষ্ঠী এই কাজ করে থাকতে পারে। গত মে মাসে ওয়ানাক্রাই র‌্যানসমওয়্যার ভাইরাস অ্যাটাকেও তাদের হাত ছিল। ওই ভাইরাস অ্যাটাকে বিশ্বের কয়েক কোটি কম্পিউটার আক্রান্ত হয়েছিল।

বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরির অংক আরও বড় হতে পারত। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেভাবেই তারা সুইফ মেসেজ পাঠায় নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে। কিন্তু কয়েকটি অ্যাকাউন্টের অর্থ পাঠানোর পর বিষয়টি ধরা পড়ে যায় এবং অর্থ পাঠানো বন্ধ করা হয়।

চীনা এই জুয়াড়ি ডিং ও গাওয়ের অনলাইন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বহুদিন ধরেই এরা দুজনে মিলে অবৈধ জুয়ার আসর চালানোর পাশাপাশি এসব কাজে লোক নিয়োগ করে আসছিল। চীনের আদালতের তথ্যমতে, এগুলোই ছিল তাদের প্রধান ব্যবসা। ব্লুমবার্গ মার্কেট অনুসন্ধান করে এবং এই জুয়াড়িদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, ২০১৬ সালের মার্চেই ডিং ও গাওয়ের ক্যাসিনো অ্যাকাউন্ট চীন সরকার জব্দ করে দেয়।

সর্বশেষ খবর