সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রণবের মুখে জিয়া-খালেদার কথা

নঈম নিজাম, নয়াদিল্লি থেকে

প্রণবের মুখে জিয়া-খালেদার কথা

প্রণব মুখার্জি

আড্ডায়-আলোচনায় বাংলাদেশ নিয়ে প্রণব মুখার্জি অনেক কথাই বললেন। স্মরণ করলেন তার প্রয়াত স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির কথা। বললেন, ও তো নড়াইলের মেয়ে। বাংলাদেশের প্রতি সবসময়ই তার দরদ ছিল। বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে তাকে আলাদা করে আপ্যায়ন করত। আমি বললাম, দাদা সেটা আপনিও করেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আপনার দরদ ভালোবাসা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সবার দেখা। মুক্তিযুদ্ধের পরও আপনি বার বার বাংলাদেশে গেছেন। দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, এ উপমহাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখতে হবে। সহনশীলতা বাড়াতে হবে। মানুষে মানুষে বিভেদ দূর করতে হবে।

কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে বিভিন্ন সময় মন্ত্রী থাকাকালে তার বাংলাদেশ সফরের কথা। তিনি বললেন, জিয়াউর রহমানের শাসনকালে মন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন দুবার। তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়া দুবারই বঙ্গভবনে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাকে। তিনিও জিয়ার আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন। সে সময় বেগম খালেদা জিয়া তার স্বামীর পাশেই ছিলেন।

এরপর আমি বললাম, রাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনি যখন ঢাকা সফর করলেন, তখন বিএনপি থেকেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের সময় নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে অবরোধের অজুহাতে বেগম জিয়া আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। ভারতের ব্যুরোক্রেসি এ কারণে এখনো ক্ষুব্ধ। তখন কূটনৈতিক শিষ্টাচার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল আমাদের দেশেও। জবাবে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি আমার দিকে তাকালেন, মৃদু হাসলেন। এ প্রসঙ্গে কিছু না বলে আমার কাছে জানতে চাইলেন, বিএনপির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবের বাড়ি কি বাগেরহাট অঞ্চলে ছিল? আমি বললাম, বাগেরহাট জেলাতেই ছিল। মোস্তাফিজুর রহমান তার সঙ্গে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ রক্ষা করতেন বলেও জানালেন প্রণব মুখার্জি।  এরপর উঠে আসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিছু ঘটনা। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের প্রশংসাও ফুটে উঠল তার মুখে। বললেন, ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমাকে ব্যথিত করেছিল। ক্ষণিকের জন্য নীরব থাকলেন। পরক্ষণেই বললেন, খালেদের সঙ্গে ভারতকে জড়িয়ে যে প্রচারণা ছিল, তার কোনোটিই সত্য ছিল না। মাঝে মাঝে এ ধরনের অপপ্রচার নিষ্ঠুর অধ্যায়ের সূচনা করে। সম্পর্কের বৈরিতা তৈরি করে একে অপরের। আলাপ চলাকালে তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমেরও খোঁজখবর নিচ্ছিলেন।  ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলতে থাকে। প্রায় এক ঘণ্টা আমাদেরকে ভিতরে গল্প করতে দেখে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা রক্ষীরা উঁকি দিয়ে গেল। প্রণব মুখার্জিকে প্রাণবন্ত দেখে তারাও খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিল বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রণব দা বললেন, ‘দিল্লি এলেই সরাসরি চলে আসবে। চা খাব, গল্প করব।’ আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবীয় গুণাবলী এবং দেশের জন্য ইতিবাচক রাজনীতির কথাও উল্লেখ করলেন। প্রশংসা করলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা বিশ্বে যে অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে তারও প্রশংসা করলেন তিনি।  জানতে চাইলাম, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন কোনো দেশ আমন্ত্রণ জানালে যাবেন কিনা। তিনি বললেন, একমাত্র একাডেমিক ছাড়া কোনো আমন্ত্রণই গ্রহণ করব না। একাডেমিক কিছু হলে হয়তো অংশ নেব। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, অর্থসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে অনেক ঘুরেছি। এখন বাকি জীবন পড়াশোনা ও লেখালেখি করে কাটাতে চাই। নিজের জীবনের খণ্ডচিত্রগুলো লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরব। আমি বললাম, মানুষকে আপনার এখনো অনেক কিছু দেওয়ার আছে। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব বিষয়েই। তিনি হাসলেন। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে ৯টার ঘরে। প্রণব দার কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম রাত সাড়ে ৮টায়। বিদায় মুহূর্তে আরও কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বললেন। আমি বললাম, প্রথমবার যখন আপনার কাছে এসেছিলাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ফোন করেছিলেন। তিনি বললেন, মনে আছে। আমি আবার বললাম, কাদের সিদ্দিকীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ঢাকায় সম্প্রতি কয়েক দফা বৈঠক করেছে। তিনি শুনলেন। এক ঘণ্টা পর বেরিয়ে এলাম রাজাজি সড়কের প্রণব মুখার্জির নতুন বাড়ি থেকে। তখন এ সড়কের নীরবতা যেন আরও বেড়েছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে সরকারি বাসভবনে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে এ দীর্ঘ আলোচনায় মনে হলো, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা সবসময়ই এক রকম। এ উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে তার যে শক্ত অবস্থান ছিল, সে চিন্তাও অপরিবর্তিত। বাংলাদেশের সবসময়ের এই বন্ধু এখনো হিমালয় সমান বুক উঁচিয়ে এ উপমহাদেশের সব ইতিবাচক ধারার পক্ষে। রাষ্ট্রপতি থাকাকালেও তার চোখে কখনো অহংকার দেখিনি। এ কারণেই হয়তো নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, প্রণব মুখার্জি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনকে জনগণের স্থাপনাতে পরিণত করেছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা। আগামীতেও হয়তো তা-ই থেকে যাবেন। আনন্দবাজার পত্রিকার একজন সাংবাদিক আমাকে বললেন, প্রণব মুখার্জি আসলে শুধু ভারতের নেতা ছিলেন না; তিনি এ উপমহাদেশের অভিভাবকের মতোই ছিলেন। এ কারণে নওয়াজ-বেনজির তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। শ্রীলঙ্কার অনেক সংকটেও তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আগামী দিনেও যেখানে যেভাবেই থাকেন তার এ ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকা দরকার। আনন্দবাজারের এই সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে দ্বিমত করতে পারলাম না। প্রণব দা আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আপনার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা।

সর্বশেষ খবর