মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

মন্ত্রিসভায় তুমুল আলোচনা

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের অপ্রাসঙ্গিক বিষয় জনগণের সামনে তুলে ধরার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

নিজামুল হক বিপুল

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে থাকা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো মোচনের (এক্সপাঞ্জ) জন্য পিটিশন করবে সরকার। একই সঙ্গে রায়ের অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া রায়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে আজ ব্রিফিং করার জন্য আইনমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন তিনি। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত ওই আলোচনায় মন্ত্রিসভার সিনিয়র সব সদস্যসহ অধিকাংশ সদস্য অংশ নেন। সবার বক্তব্যে রায় নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছিল। মন্ত্রিসভা বৈঠকসূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনার শুরুতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ কপি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। এ সময় তিনি রায়ের অনেক অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিষয়ে যে আদেশ প্রধান বিচারপতি দিয়েছেন, তা তিনি দিতে পারেন না।’ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর পরই আলোচনা শুরু হয়। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুসহ সিনিয়র মন্ত্রীরা আলোচনায় অংশ নেন। বৈঠকসূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রায়ের ভিতরে অপ্রাসঙ্গিক যেসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, রায় ভালো করে পড়ে সেগুলোর বিষয়ে সবাই কথা বলবেন।’ তিনি বলেন, ‘আগে রায় জেনেছিলাম মাত্র। এবার রায়ের কপি হাতে পেলাম, দেখলাম, পড়লাম ও বুঝলাম। এ রায়ের কোথাও কোথাও সরকার এবং জনগণ সম্পর্কে “আপত্তিকর” মন্তব্য করা হয়েছে। কাজেই আপনারা যেখানেই সুযোগ পাবেন সেখানে এসব বিষয় জনগণকে জানাবেন। কারণ, আমরা জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের এসব বিষয় জানার অধিকার আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, জনগণের সংসদের দেওয়া আইন মানছে না, অথচ সামরিক আইন ঠিকই মানছে।’ রায়ে যেসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আছে সেগুলো বাতিলের জন্য পিটিশন করার জন্য আইনমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে রায়ের অপ্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে আজ (মঙ্গলবার) সংবাদ সম্মেলন করারও নির্দেশ দেন তিনি। সূত্র জানায়, বৈঠকে আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যরা বলেছেন, রায়ে ‘আমিত্ব’সহ সবকিছু অপ্রাসঙ্গিক। প্রধান বিচারপতি মনের মাধুরী মিশিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেছেন। মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের কেউ কেউ বৈঠকে বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এসব করছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে। বর্তমানে বিভিন্ন ফোর্স অ্যাকটিভ আছে। তাদের জন্য তিনি গ্রাউন্ড তৈরি করছেন। একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হলেও তা কোনো সংকট তৈরি করবে না। পার্লামেন্টই সঠিক। সূত্র জানায়, রায়ের বিভিন্ন স্থানে অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ের এক জায়গায় বলা হয়েছে, বর্তমান সংসদ অযোগ্য। এই পার্লামেন্ট ইমম্যাচিউরড। রায়ের এই বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রিসভার একাধিক সিনিয়র সদস্য বলেছেন, ‘আমরা যদি অযোগ্য হয়ে থাকি তাহলে, আমরা যে একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করলাম তিনি অযোগ্য। আমরা একজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করলাম, তাহলে তিনিও অযোগ্য। রায়ের এক স্থানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলা হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে আমরা যে একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছি তিনি প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা যে প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচিত করেছি তিনিও প্রশ্নবিদ্ধ।’ রায়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রিসভার সদস্যরা বলেছেন, ‘১১৬ অনুচ্ছেদ কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্টের হাতে দিতে পারি না।’ আলোচনায় সিনিয়র এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্য ভালো নয়। নইলে তিনি এই সময়ে এসব নিয়ে আসবেন কেন?’ শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুসহ ৪০৩ জন গণপরিষদ সদস্য যে সংবিধান তৈরি করেন তাতে ৯৬ অনুচ্ছেদ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে সামরিক আইনের সরকার পাকিস্তানকে অনুসরণ করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে। পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশকে ফলো করে আমরা ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করেছিলাম। কিন্তু তা কোর্ট বাতিল করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ বিচারপতিদের বেশি সুরক্ষা দেবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেলে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। ওই প্রতিবেদনের আলোকে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত বিচারককে অপসারণ করবেন। কিন্তু সংসদের হাতে থাকলে সেটি সহজে হবে না। দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামত লাগবে।’

সাত দেশে নতুন বাংলাদেশ মিশন : এদিকে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে বিদেশে নতুন সাতটি বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগে থেকে বিদেশে স্থাপিত ১৭টি বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের বিষয়ে ভূতাপেক্ষা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল, সুদানের রাজধানী খার্তুম, নাইজেরিয়ার ফ্রিটাউন, রুমানিয়ার বুখারেস্ট, ভারতের চেন্নাই, কানাডার টরেন্টো ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নতুন করে বাংলাদেশ মিশন হবে। এ ছাড়া গতকালের বৈঠকে নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৭-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইনে তেমন পরিবর্তন নেই জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শুধু বোর্ডের সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আগে সাত সদস্যের বোর্ড ছিল। এখন তা করা হয়েছে নয় সদস্যের। এ ছাড়া ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অন ফ্যাসিলিটিশন অব ক্রস-বর্ডার পেপারলেস ট্রেড ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকে বাংলাদেশের পার্টি হওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর