বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ষোড়শ সংশোধনীর রায় অপরিকল্পিত ও অপ্রাসঙ্গিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ষোড়শ সংশোধনীর রায় অপরিকল্পিত ও অপ্রাসঙ্গিক

বিচারপতি খায়রুল হক

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এ রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পূর্বপরিকল্পিত কিনা সে বিষয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। খায়রুল হক বলেন, রায়ে সংসদ সদস্যদের ইমম্যাচিউরড বললে বিচারপতিদেরও ইমম্যাচিউরিটি প্রকাশ পায়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে গতকাল আইন কমিশন কার্যালয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, রায়ে পার্লামেন্টকে ইমম্যাচিউরড বলা হয়েছে। এটা বলা ঠিক হয়নি। রাষ্ট্রের একটি বডি অন্য একটি বডিকে এভাবে বলতে পারে না। তাহলে সুস্পষ্টভাবেই বলতে হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও ইমম্যাচিউরড। এমনকি আনফরচুনেট হচ্ছে, ‘আপিল বিভাগের রায়ের যিনি অথর জাজ (প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা), তিনি রায়ের ২০৬ পৃষ্ঠায় এমপিদের ইমম্যাচিউরড বলেছেন। এটা বাঞ্ছিত নয়। আমরা যদি পরস্পরকে সম্মান করতে না শিখি, দুই পক্ষই (আদালত ও সংসদ) অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করি, তাহলে যারা যারা বলছেন, তাতে সবারই অপরিপক্বতা প্রকাশ পায়।’ রায়ে এমপিদের সমালোচনা করা হয়েছে উল্লেখ করে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, তাদের (এমপিদের) যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিচারপতিদের যোগ্যতা নিয়ে এমপি সাহেবরা এখন যদি বলেন যে হাই কোর্টের জাজরা জাজ হওয়ার যোগ্য কিনা, তা তারা বিবেচনা করে দেখবেন, তাহেল কেমন হয়! এসব কথায় বরং বিজ্ঞ বিচারপতিদেরই ইমম্যাচিউরিটি প্রকাশ পায়। এটা অভিপ্রেত ছিল না।

তিনি বলেন, ‘আমরা এ মামলার শুনানির আগেই খেয়াল করেছি, অনেক বিচারপতি সেমিনারে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, এমপিদের ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক কথা বলেছেন। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে, এমপিদের ব্যাপারে কি এ রায়ের আগেই তাদের মনে এই ধারণা ছিল? এসব কি পূর্বপরিকল্পিত যে এমপিরা অজ্ঞ, অশিক্ষিত? এগুলো তো আমরা পত্রিকায় দেখেছি। এগুলো যদি তিনি (প্রধান বিচারপতি) রায়ের আগেই বলে থাকেন, তাহলে তো বলা হবে, রায় ও শুনানি সবই পূর্বপরিকল্পিত। এটা আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করা ছিল। শুনানি করা লাগেনি। তার মনের মধ্যেই এটা ছিল যে, এমপিরা অজ্ঞ, অশিক্ষিত। তারা জানেন না, তারা এর উপযুক্ত না। এটা তো গুড জাজেজ বিহেভিয়ার হতে পারে না।’

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, রায়ে ৭০ অনুচ্ছেদের সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সংসদে কিন্তু দলের বিপক্ষে ভোটাভুটি হয় না। ভোটাভুটি হয় বিলের পক্ষে-বিপক্ষে। এমপিরা স্বাধীন। কিন্তু তারা স্বাধীনতা প্রয়োগ করবেন কিনা তা তাদের বিষয়। সাংবাদিকরা কি তাদের এডিটরের সামনে সব কথা বলেন? তার মানে কি এই যে, সাংবাদিকরা স্বাধীন নন? দলের বিরুদ্ধে একবারই ভোট হতে পারে, যদি নো কনফিডেন্স মোশন থাকে। সেই ভোটও এমপিরা দলের বিপক্ষে দিতে পারবেন। অবশ্য তাতে সংসদ সদস্যপদ থাকবে না।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে নিজের মত ব্যক্ত করে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বলা হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। এই কথার সঙ্গে আমি একমত নই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে এত কুম্ভিরাশ্রু অপ্রয়োজনীয়। এটি (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) যখন সংবিধানে ছিল না তখনো তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল। ছিল না কেউ বলতে পারবে না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছাড়াই তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল এতকাল। আমি জুডিশিয়ারির প্রথম দিকের কথা বলছি। কাজেই এর সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সে রকম সম্পর্ক নেই। বরং এটিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মোড়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে নিয়ে সংসদের হাতে দিলেও ক্ষমতার অপব্যবহার হবে তা বলা যায় না। এটা (বিচারপতি অপসারণ) সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকলেও তো ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কাউন্সিলের কাছে থাকার চেয়ে সংসদের কাছে থাকাই ভালো। কাউন্সিলকে যে আমরা ভরসা করব তা বলতে পারি না।’ এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাবেক একজন বিচারপতির দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম শুরু না করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব! এতেই প্রমাণিত হয় বিচারপতিরা নিরপেক্ষ নন। এতে তাদের সম্পর্কে আমাদের ভরসা কি টলে যায় না?’

খায়রুল হক বলেন, ‘জনগণ এ রিপাবলিকের (বাংলাদেশ রাষ্ট্র) মালিক। জনগণ সার্বভৌম। এর প্রতিনিধিত্ব করে সংসদ। কাজেই সবারই সংসদের কাছে জবাবদিহির বিষয় আছে। বিচারপতিদের তো সেটা না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এ রায়ের পর এখন মনে হচ্ছে, এটি জনগণের প্রজাতন্ত্র বা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নয়। বরং মনে হচ্ছে, জাজেজ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। কারণ জনগণের প্রতি যে জবাবদিহি ছিল, তা সুপ্রিম কোর্ট অপসারণ করেছেন।’ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিচার বিভাগ, সংসদ কেউ কারও চেয়ে ছোট-বড় না। একটি আরেকটির পরিপূরক। তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ ভুল করলে সুপ্রিম কোর্ট তা শোধরাবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ভুল করলে আমরা কোথায় যাব। এটা আমার বার্নিং কোয়েশ্চন।’

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সপক্ষে বলা হয়েছে, এটি না থাকলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির কথা শুনবেন না। কিন্তু তার (প্রধান বিচারপতি) এটি মনে হলো কেন? তিনি কি হেডমাস্টার? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা কি তার ছাত্র? এটি আনএক্সপেকটেড, আনবিলিভেবল। আমিও তো হাই কোর্টের জাজ ছিলাম। আমাকে তো আমার প্রধান বিচারপতি কিছু বলেননি। এখন কেন বলা হচ্ছে। হাই কোর্টের জাজরা সবাই স্বাধীন। এমনকি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও।’

আপনার দেওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে অনেক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এসেছে— এমন প্রশ্নে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার সময় এটা নয়। নিজের রায় নিয়ে বিচারকরা নিজে কথা বলেন না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তো মূল সংবিধানে ছিল না। তাই এ রায়ে তা বহাল হতে পারে না। সংসদকে এ বিষয়ে আইন পাস করতে হবে।

সর্বশেষ খবর