শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

আগুনে অচল শাহজালাল

তিন ঘণ্টা বিমান চলাচল বন্ধ। যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক। রহস্য জানতে কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগুনে অচল শাহজালাল

আগুনে বিধ্বস্ত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় তলার একটি কক্ষ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল দুপুর ১টা ৩৭ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১০টি ইউনিট পৌনে ২ ঘণ্টার চেষ্টায় বিকাল ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে এয়ার ইন্ডিয়ার পাশের কাতার এয়ারওয়েজ, সৌদি অ্যারাবিয়া এয়ারলাইনস ও চতুর্থ তলার ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, অপেক্ষমাণ যাত্রী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে। টানা ৩ ঘণ্টা কার্যত অচল থাকে পড়ে শাহজালাল বিমানবন্দর। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে, দুপুর ১টা ৩৭ মিনিটে ধোঁয়া ও ফায়ার অ্যালার্মের মাধ্যমেই বিমানবন্দরে দায়িত্বরতরা আগুনের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে আগুন লাগার বিষয়টি মুহূর্তেই  বিমানবন্দরের সব কটি ইউনিট অবগত হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই বিমানবন্দরের অভ্যন্তর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে ছুটে যান বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীসহ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। দ্রুততম সময়েই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে এরই মধ্যে বিমানবন্দরে থাকা যাত্রী ও তাদের স্বজনদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় অনেককেই হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা গেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের উদ্বিগ্ন না হতে অনুরোধ করলেও সবার চোখেমুখেই ছিল উৎকণ্ঠার ছাপ।

ঘটনাস্থলে থাকা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের সময় এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল। এ সময় ধোঁয়ায় তৃতীয় ও চতুর্থ তলা অন্ধকার হয়ে যায়। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সৌদি এয়ারলাইনস, কাতার এয়ারওয়েজের অফিসের কিছু অংশে। এয়ার ইন্ডিয়ার ঠিক ওপরে চতুর্থ তলায় থাকা ইতিহাদ এয়ারওয়েজের অফিসের ফ্লোরের টাইলস আগুনের তাপে উঠে আসে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসের তালা ভেঙে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এয়ার ইন্ডিয়ার অফিস।

সূত্র বলছে, গতকাল দেড়টার পর থেকে দেশি ও বিদেশি এয়ারলাইনসের মোট ২৭টি ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও গত রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত কোনো ফ্লাইট ছেড়ে যেতে পারেনি। সূত্র বলছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমানবন্দরের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো এয়ারলাইনস যাত্রীদের চেক-ইন করাতে পারেনি। বিকাল ৪টায় শুরু হয় চেক-ইন। এর আগে গ্রিন সিগন্যাল না পেয়ে সৌদি এয়ারলাইনস, মালিন্দ এয়ার ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চারটি ফ্লাইট আধঘণ্টারও বেশি সময় আকাশে ঘুরে অবতরণ করে। এর মধ্যে রিয়াদ থেকে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে অবতরণের কথা থাকলেও বিমানটি অতিরিক্ত ৩০ মিনিট আকাশে ঘুরতে থাকে। সবশেষ অবতরণ করে বিকাল ৪টায়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গত রাত পৌনে ৯টায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটের পর বিমানের আরও আটটি ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। আটটি ফ্লাইটের মধ্যে সন্ধ্যা ৬টায় ছিল আবুধাবির ফ্লাইট। ৭টা ৫৫ মিনিটে ছিল হজ ফ্লাইট। এখন পর্যন্ত আমরা তিনটি ফ্লাইটের শিডিউল পেয়েছি।’

এয়ার ইন্ডিয়ার স্টেশন ম্যানেজার রাজেন্দ্র কলি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের সময় আমাদের অফিস তালাবদ্ধ ছিল। সেখানে তখন কারও থাকার কথাও নয়। সাধারণত বিকাল ৩টার আগে-পরে আমাদের স্টাফরা অফিসে আসেন। রাতের ফ্লাইটের প্রস্তুতি নেন। রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে অ্যারাইভাল হয় এবং রাত ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে ডিপারচার হয়। আগুন কীভাবে লাগল এ বিষয়ে আমরা কোনো ধারণাই করতে পারছি না।’

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি : ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানান, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের মূল ভবনের তৃতীয় তলায় আগুনের ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য হলেন ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা) দেবাশিস বর্ধন, সহকারী পরিচালক (ঢাকা) মামুন মাহমুদ ও কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবদুল মান্নান। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’

যাত্রীরা যা বললেন : সৌদি এয়ারলাইনসের যাত্রী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গতকাল সোয়া ৫টায় আমার ফ্লাইট ছিল। এজন্য ১টার সময় শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিতরে প্রবেশ করি। মালামাল বুকিং দিই। দেড়টার পর আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের ধোঁয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ১টা ৪১ মিনিটে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসি। ভিতরে প্রবেশের জন্য মাইকিং করা হলে সাড়ে ৪টার দিকে আবার ভিতরে প্রবেশ করি।’ সোয়া ৫টায় ওই যাত্রী জানান, ইমিগ্রেশনে এখনো বিদ্যুৎ না আসায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তিনি তখনো লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের হজযাত্রী আলী আহমদ জানান, তৃতীয় তলায় জুমার নামাজ আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় আগুনের ধোঁয়া তাদের ছেয়ে ফেলে। তিনিসহ নামাজিরা নামাজ না পড়েই ভয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসেন।

শর্ট-সার্কিটেই আগুন! : এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের (এএপি) এএসপি আফতাব উদ্দিন জানান, ‘বিমানবন্দর টার্মিনাল ভবনের তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইনসের অফিস থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। আগুনের সময় ওই অফিসে কেউ ছিল না। সংশ্লিষ্টরা ওই অফিসের তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার উপস্থিতি বেশি ছিল।’

ফ্লাইট বাতিল হয়নি : শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক কাজী ইকবাল করিম জানান, বিমানবন্দরে আগুন লাগার পর যাত্রীদের ভিতর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও টার্মিনালের ভিতরে ধোঁয়া ছিল। ফলে যাত্রীদের ভিতরে প্রবেশে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু কোনো ফ্লাইট বাতিল করা হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্ত যেসব অফিস : এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইনসের অফিসে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের মতো বিকট শব্দ হয়। এতে ওই অফিসের গ্লাস ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এয়ার ইন্ডিয়া অফিসের পাশে সৌদি ও কাতার এয়ারলাইনসের অফিস ছিল। আগুনে সেসব অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া এয়ার ইন্ডিয়া অফিসের উপরে ইতিহাদ এয়ারলাইনসের অফিস ছিল। ওই অফিসের টাইলস ছিন্নভিন্ন হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর