শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মানুষের সেবা করতে চাইলে রাজনীতি করো

দেশে চলছে রুগ্ন রাজনীতি সুপ্রিম কোর্টের রায় ঐতিহাসিক

মাহমুদ আজহার

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মানুষের সেবা করতে চাইলে রাজনীতি করো

সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় আমাকে বলতেন, তুমি অনেক টাকা আয় করতে পার। সমাজে যশ-খ্যাতিও অর্জন করতে পার। কিন্তু মানুষের সেবা করতে চাইলে রাজনীতি করতে হবে। এতে মানুষের যে ভালোবাসা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে কোনো তুলনা হয় না। এটা কত যে সত্য কথা ছিল, তা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি। সেই জনগণের রাজনীতির জন্যই বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন।’

রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ এই নেতা। খোলামেলা আলোচনায় তিনি দেশের রাজনীতি, আগামী নির্বাচন, সংলাপ ও তরুণ সমাজ নিয়ে কথা বলেন।

রাজনীতি কোন পথে—জানতে চাইলে ড. কামাল বলেন, ‘নানা কারণে দেশে এখন রুগ্ন রাজনীতি চলছে। কোনো আলাপ আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ করে আইন হয়ে যাচ্ছে। সংবিধান সংশোধন হয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে রুগ্ন রাজনীতি ছাড়া আর কিইবা বলার আছে? দেশের রাজনীতিকে জাগ্রত করার জন্য আমরা সবাই চেষ্টা করছি। কেননা সুষ্ঠু রাজনীতির মাধ্যমেই পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব। গণতন্ত্র কার্যকরভাবে পেতে হলে এর বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে প্রাণে চাই, সুস্থ ও ইতিবাচক রাজনীতি। সংবিধান কাগজে কলমে নয়, কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সংবিধানের অনেক বিধানই আছে, যেগুলোকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে না, কিংবা কার্যকর করা হচ্ছে না।’ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে কামাল হোসেন বলেন, ‘এ রায়কে ঐতিহাসিক বলেই মনে করছি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। রায়ের পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্র, নির্বাচন, গণতন্ত্র নিয়েও কথা এসেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ওই সময় বলা হয়েছিল, দ্রুত আরেকটি নির্বাচন দেওয়া হবে। এটাও বলা হয়েছিল, এটা ধারাবাহিকতার নির্বাচন। পরে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু তিন বছর পার হয়ে গেলেও দেওয়া হয়নি। আমিও অনেককে বলেছিলাম, এ নিয়ে অতীতমুখী না হয়ে সামনে দ্রুত একটি নির্বাচন হলেও সমস্যা নেই।’ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমেই তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে এ প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, ‘রায়ে কিন্তু এটাও বলা হয়েছিল, আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে পারে। দেশের জনগণ কখনই চায় না, ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন হোক। সবাই চায়, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিগত সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষ। যে কারণে ২০০৮ সালে আমি ১৪ দলে ছিলাম। আমি শুধু দাবিই করিনি, মামলা করেছি। ভোটার লিস্ট নতুন করে করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন (প্রয়াত) আহমদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন না। আমাদের দেশদ্রোহের মামলার শিকার হতে হয়েছিল। বিশেষ করে আমি, আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদসহ কয়েকজন আইনজীবীকে। তখন ১৪ দলসহ সবারই দাবি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হতে পারে না। কিন্তু আজ হঠাৎ করে কেন অসাংবিধানিক হয়ে গেল?’ তৃতীয় ধারার নতুন জোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নতুন জোট নিয়ে এখনো কিছু বলার সময় আসেনি। তবে আমি সবসময় জনগণের ঐক্যের দাবি করে আসছি। কয়েকটি দলে আলাপ আলোচনা চলছে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারব। নতুন জোট সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় আসছে। এটা কিন্তু আমার কোনো কথা নয়।’ একাদশ জাতীয় সংসদ কোন সরকারের অধীনে হলে সুষ্ঠু হতে পারে? ড. কামাল বলেন, ‘সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ নির্বাচনের দাবিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা হয়েছিল। ২০০৮ সালেই বা কেন আমরা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরুদ্ধার করেছিলাম। কেন করেছিলাম, সবারই জানা। এই সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সর্বশেষ উপকৃত হয়েছে। তারা কেন এখন সরে গেল তাদেরই জিজ্ঞাসা করা দরকার।’ জাতীয় স্বার্থে সংলাপ জরুরি বলে মনে করেন এই রাজনীতিক। তার মতে, ‘জাতীয় ইস্যুগুলো নিয়ে এখনই একটি রাজনৈতিক সংলাপ হতে পারে। তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে তা হতে হবে অর্থবহ, লোক দেখানোর জন্য নয়। তথাকথিত যেন না হয়। বিলম্ব হওয়ার সুযোগ নেই। দেশের জনগণ ক্ষমতার মালিক। তাদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া উচিত।’ আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জনগণ ক্ষমতার মালিক এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের অবদান, তার রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য সংবিধানে যে লেখা আছে, বৈষম্যমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ—সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত। আওয়ামী লীগকে বলব, আইন ও সংবিধান মেনে তাদের অগ্রসর হওয়া উচিত। যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তারা অন্তর থেকেই শ্রদ্ধা করে রাজনীতি করেন তাহলে টাকা-পয়সা লোভ-লালসা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া উচিত। সেটাই আমরা আশা করি।’ বিএনপির রাজনীতি প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, ‘তারা নির্বাচনে আসবে আসবে বলছে, এটাকে স্বাগত জানানো উচিত। দেশের আইন ও সংবিধান মেনে রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। তাদের ইতিবাচক রাজনীতিতেই থাকা উচিত।’ আপনার কাছে রাজনীতি না আইন পেশা কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আইন পেশাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছি। সেই রাজনীতি আর ফিরে আসবে না। তরুণদের বলব, অতীতে আমরা যে রাজনীতি দেখেছি, সেই রাজনীতিই তোমরা ভবিষ্যতে করবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ঘিরে জনগণের ক্ষমতায়নের রাজনীতি দেখতে চাই। ষাটের দশকের রাজনীতি সম্পর্ক বিশেষ করে ৬ দফা ও ১১ দফায় তরুণদের যে ভূমিকা ছিল, সেদিকে এখন সবার ফিরে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু তরুণদের ওপর ভর করেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন। দেশ স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলের রাজনীতি আর এখনকার রাজনীতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমি এগুলো লিখে যাব। এ নিয়ে নতুন করে কোনো বিতর্কে জড়াতে চাই না।’ তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তবে এখনকার তরুণদের ভালো কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। গোলাগুলি, নিজেরা নিজেরা মারামারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির কল্পনাই করা যেত না। এখন তা হরহামেশা হচ্ছে। আমি মনে করি, ডাকসুসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন দিয়ে ছাত্রদের পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের অধিকার আদায় নিয়ে ব্যস্ত রাখা জরুরি।’ নিজের পরিবার সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার স্ত্রী ড. হামিদা হোসেন এবং দুই মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও দীনা হোসেন। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ পরিবার নিয়ে ভালোই আছি, সুখে আছি। নাতি-নাতনি নিয়ে বেইলি রোডের বাসায় একসঙ্গে থাকি।’

সর্বশেষ খবর