শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্বকে সাহস জোগাচ্ছে বাংলাদেশ

তৈরি পোশাকে চীনের একক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বাংলাদেশ গত ২০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে মিরাকল ঘটিয়েছে। মাত্র কয়েক যুগ আগেও এটি ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। ছিল দুর্ভিক্ষ ও বন্যায় পর্যুদস্ত। কিন্তু এখন এটি মধ্য আয়ের দেশ। ভিয়েতনামও একই সাফল্য দেখিয়েছে। কম্বোডিয়াও আছে একই পথে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন নতুন এসব ‘ম্যানুফ্যাকচারিং শক্তি’ আশার সঞ্চার করেছে। দূর করেছে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিল্পধসের শঙ্কা। বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের অন্য অর্থনীতিগুলোর জন্য সাহস জোগাচ্ছে। এমনকি ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্রে চীনের অনন্য অবস্থানকেও চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্লোক্স টু নিউ কর্নারস অব এশিয়া’ শিরোনামে বিশ্লেষক রবিন হার্ডিংয়ের প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। খ্যাতিমান পত্রিকা ফিন্যানশিয়াল টাইমসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে এ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ আসলে যে বিশাল সাফল্য দেখিয়েছে, বিশ্ব তার খণ্ডিত অংশই দেখেছে। প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গার্মেন্টে সস্তা শ্রমই এর প্রধান চালিকাশক্তি। এখন বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। গার্মেন্ট কারখানাগুলো কয়েক লাখ নারীকে কাজ দিয়েছে। এই নারীরা এখন পেয়েছেন অর্থনৈতিক শক্তি। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোও এখন শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার নতুন এই ম্যানুফ্যাকচারিং কেন্দ্রে থাকা এসব দেশের পরিবর্তন বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রেখেছে। ভোগ্যপণ্যের বিশাল পরিমাণ নতুন বাজার তৈরি হয়েছে, বড় সুযোগ এসেছে বিনিয়োগকারীদের জন্য এবং দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসছে লাখো মানুষ। অবশ্য বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও অন্য দেশগুলো এটি অনুসরণ করবে কিনা, তা নিয়ে খানিকটা সংশয় আছে। কারণ, হার্ভার্ড ইকোনমিস্ট ড্যানি রড্রিক গবেষণা করে দরিদ্র দেশগুলোয় প্রাথমিক স্তরেই ধসের একটি ক্রমধারা আবিষ্কার করেছেন। এসব দেশে ফ্যাক্টরিগুলোর উন্নয়নের ধারাও ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়ে কম। তিনি ১৯৮০ সাল থেকে উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ধসের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থান খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু এও সত্য, উৎপাদন ছাড়া ধনী হওয়া সম্ভব নয়।

১৯৬০ সালের দিকে এশিয়ার দেশগুলোকে অনেক সময় উড়ন্ত রাজহংসীর সঙ্গে তুলনা করা হতো। সে সময়ের দিকেই জাপান ও পরে তাইওয়ান-কোরিয়া টেক্সটাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইলেকট্রনিক্সে আগ্রহী হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি বিশাল উচ্চতা অল্প সময়ে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। তাই এখনকার সময়ে এসে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য হয় নতুন করে একটি প্রবৃদ্ধি মডেল তৈরি করতেই হবে, না হয় সারা জীবন পণ্য বিক্রির চক্রেই আটকে থাকতে হবে বলে যে ভয় কাজ করছে তা আসলে ভুল। আসলে দরিদ্র দেশগুলোয় শিল্পায়নে একটি নতুন ধারা তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পথপ্রদর্শক। এটা ধীরে ধীরে সাব-সাহারা আফ্রিকায় বিস্তৃত হতে পারে। জাতিসংঘের গবেষণা বলছে, সাধারণ উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোয় ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কাজ ও চাকরির সংখ্যা কমে আসছে। এটা ভাবার কোনো কারন নেই যে, ম্যানুফ্যাকচারিং কমে গেছে বা রোবট মেশিনই সব বানাচ্ছে। আসলে বেশির ভাগ ম্যানুফ্যাকচারিং হচ্ছে এক স্থানে। সেটা চীনে। সেখানকার সুযোগ-সুবিধা এতটাই বেশি যে, অনেক ক্ষেত্রে চাইলেও কোম্পানিগুলো চীনের বাইরে কারখানা নিতে পারে না। কিন্তু অন্য ম্যানুফ্যাকচারিং অর্থনীতিগুলোতে বাঁচতে হলে অবশ্যই বড় কোম্পানিগুলোর চীননির্ভরতা কমাতে হবে। সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ তা দেখিয়েও দিয়েছে।

রবিন হার্ডিংয়ের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, চীনে শ্রমমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানিগুলো অটোমেশন পদ্ধতিতেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু এটা পুরোপুরি কাজ করবে না নানাবিধ কারণে। এর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ আকারে পুরোপুরি অটোমেশন প্রযুক্তি পেতে এখনো যুগের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। আবার পোশাকের ক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা পরিবর্তনের হারও অত্যধিক। এটা রোবটের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে আর যাই হোক এভাবে চীনের পক্ষে আর এত বিশালসংখ্যক পোশাক উৎপাদনের মতো কারখানা চালিয়ে নিয়ে তাদের প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের হার ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই চীন কম দামের পোশাক বানানো বন্ধও করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক গতিধারার নিয়মেই এখন চীনের দৃষ্টি হবে অন্য শিল্পে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ অন্য ম্যানুফ্যাকচারিং দেশগুলো নিজেদের এক অনন্য সক্ষমতা ঘোষণা দিয়েছে। চীনের শ্রমমূল্য বাড়লেও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পোশাকের মূল্য বাড়বে না— এমন আস্থায় ক্রেতাদের আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। বিশ্ব এও বুঝতে পারছে, এখন নতুন ম্যানুফ্যাকচাররাও অর্থ উপার্জনের পথে হাঁটছেন। সেই সঙ্গে উড়ন্ত রাজহংসী এখন বাংলাদেশসহ এশিয়ার নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং শক্তিগুলোর দিকেই উড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রবন্ধে।

সর্বশেষ খবর