রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

শোক ঢেকে যায় পোস্টারে

জাতীয় শোক দিবসে নেতা-পাতিনেতা, নবাগত বহিরাগতদের ছবির আত্মপ্রচার

রফিকুল ইসলাম রনি

শোক ঢেকে যায় পোস্টারে

জাতীয় শোক দিবসকে কেন্দ্র করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে নিজেদের প্রচারণায় মেতে উঠেছেন নেতারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশমুখেই বৈদ্যুতিক তারে সাঁটানো হয়েছে একটি পোস্টার। এতে একেবারে ক্ষুদ্র পরিসরে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। লেখা হয়েছে, ‘১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অঙ্গীকার শোক হোক শক্তি’। পোস্টারের বাঁ পাশে বিশালাকৃতির ছবি সাঈদ আহমেদ বাবুর। তার কোনো পদবি লেখা হয়নি। পোস্টারের মাঝখানে শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঘাতকের গুলিতে পড়ে থাকা জাতির জনকের প্রতিকৃতি। গতকাল দুপুরে এই পোস্টার দেখার সময় সাবেক এক ছাত্রনেতা বললেন, ‘নেতার ছবিতে ঢাকা পড়েছে শোকের ছায়া।’ শোকের মাস আগস্টে সাঈদ আহমেদ বাবুর পোস্টারের মতো এমন শত শত পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। বিশেষ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ প্রচারটা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জের সর্বত্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী যেন উপলক্ষ। লক্ষ্য হচ্ছে নেতা, পাতিনেতা, উঠতি নেতাদের আত্মপ্রচার। শোক দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর নামে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে নেতাদের কারও ছবি ব্যবহার না করে শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে নিহতদের ছবি ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের এ নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উঠতি ও পাতিনেতাদের চলছে আত্মপ্রচার। এখন আবার শুরু হয়েছে ডিজিটাল প্রচার-প্রচারণা। ১৫ আগস্টের শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর নামে রাজধানীসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আত্মপ্রচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাদের বড় বড় রঙিন ছবিসংবলিত বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে সব অলিগলি, প্রধান সড়ক, গুরুত্বপূর্ণ মোড়, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন এলাকা। ব্যানার-বিলবোর্ডে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির চেয়ে বেশি ‘উজ্জ্বল’ বিভিন্ন স্তরের নেতা, পাতিনেতা ও উঠতি নেতাদের আলোকচিত্র। এ দিবসের তাৎপর্য, দলীয় অঙ্গীকার, ভিশন ইত্যাদি কোনো কিছুই স্থান পাচ্ছে না কর্মসূচিতে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার ভাবগাম্ভীর্যও রক্ষা করা হচ্ছে না।

শ্রদ্ধাঞ্জলি ব্যানারে শুধু নিজেদের ছবি দিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকেননি, বঙ্গবন্ধুর নাম গৌণ করে বড় আকারে লিখিয়েছেন তাদের নাম। দেখে মনে হয়, জাতির জনকের শাহাদাতবার্ষিকী পালন যেন অসিলামাত্র। নিজেদের ‘শ্রদ্ধেয়’ করে তোলার কাজেই গভীর মনোযোগী ক্ষমতাসীন দলের এই নেতারা। এসব পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন আর বিলবোর্ডে ১৫ আগস্টের শহীদদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যাদের সৌজন্যে এসব টানানো হয়েছে সেই নেতাদের ছবি। ছবিগুলো এমনভাবে স্থান পেয়েছে যে কে শহীদ আর কে জীবিত, অনেক ক্ষেত্রে তা বোঝা কষ্টকর। বরং অনেক বিলবোর্ড-ব্যানারে প্রচারকারী নেতা-নেত্রীর ছবি, নাম ও পদ-পদবি যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা রীতিমতো অরুচিকর।

বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, ওপরের বাঁ পাশে ছোট করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। আরেক পাশে মাঝারি করে কেন্দ্রীয় এক নেতার ছবি ও স্থানীয় কোনো নেতার ছবি আর মাঝখানে রয়েছে বড় আকারে কোনো পাতিনেতার ছবি।

গতকাল সরেজমিন ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, অর্ধশত ফেস্টুন টানানো রয়েছে বিভিন্ন তার ও বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছের সঙ্গে। তাঁতী লীগ ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মো. মোজাহারুল ইসলাম সোহেলের ছবি বড়, তার চেয়ে একটু ছোট করে দেওয়া হয়েছে সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান ভুইয়ার ছবি। বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলনামূলক একটু বড় দিলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি খুব ছোট আকারে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে ফেস্টুনে। এ ফেস্টুনটি কয়েকটি স্থানে শোভা পাচ্ছে। দলীয় সভানেত্রীর অফিস থেকে বের হলেই চোখে পড়ে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি বড় পোস্টার। দলীয় সভানেত্রীর অফিসে প্রবেশমুখের সামনেই খুঁটি সঙ্গে লাগানো হয়েছে পোস্টারটি। পোস্টারটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ছবি বড় করে দেওয়া হয়েছে। এরপর ১৫ আগস্ট নিহত শহীদদের ছবি। তারপর তিনটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এই ছবিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের ছবি একটু বড়, তারপর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথের ছবি দেওয়া হয়েছে। ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে এ পোস্টারটি সাঁটিয়েছেন ঢাকা উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের পলাশ মোল্লা। তবে তার পদবি লেখা হয়নি। শুধু দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ই নয়, রাজধানীসহ সারা দেশই এ পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কাজী সিরাজুল ইসলামের একটি পোস্টার। বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহতদের ছবি দেখতে অনেকটাই দুরবিন প্রয়োজন হয়। আর কাজী সিরাজুল ইসলামের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে পোস্টারের সিংহভাগ জুড়ে। তিনি ফরিদপুর-১ আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকার ইসিবি চত্বরে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোহাগের। সেখানে জাতির জনকের ছবির চেয়ে তার ছবি বড় করে দেওয়া। এ ছাড়া যুবলীগ চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগরী উত্তর যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ছবি ছোট পরিসরে স্থান পেয়েছে।

সারা দেশে রাস্তাঘাট, অলিগলি, প্রধান সড়ক, গুরুত্বপূর্ণ মোড়, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন এলাকাই নয়; এসব নেতা, পাতিনেতা, উঠতি নেতা, হাইব্রিড নেতার বড় বড় রঙিন ছবিসংবলিত বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটারেও শোভা পাচ্ছে। কেউ কেউ নিজের ফেসবুকে অথবা তাদের কর্মী-সমর্থকদের ফেসবুকে এসব ছবি দিয়ে আত্মপ্রচারে ব্রতী হয়েছেন। ফেসবুকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো একটি পোস্টার পাওয়া গেছে ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি মো. নবী নেওয়াজের। এ পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর একক ছবি ও নবী নেওয়াজের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ফেসবুক পেজে আরেকটি ছবি পাওয়া গেছে যশোরের মনিরামপুর পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জি এম অনীক ফয়সালের। তার পোস্টারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে তার ছবি বড় আকারে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় তিন নেতার ছবি রয়েছে ওই পোস্টারে। পাবনার ফরিদপুর বৃলাহিড়ীবাড়ী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির জাতির জনকের ছবির চেয়ে নিজের ছবি বড় দিয়ে একটি পোস্টার করেছেন। ওই পোস্টারে স্থানীয় এমপিসহ আরও কয়েকজনের ছবিও রয়েছে। আওয়ামী লীগের অনুমোদন না থাকলেও ভুঁইফোড় সংগঠন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডি জে শাকিল এমন একটি পোস্টার সাঁটিয়েছেন সর্বত্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর