রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশৃঙ্খলার শেষ নেই শাহজালালে

সাঈদুর রহমান রিমন

বিশৃঙ্খলার শেষ নেই শাহজালালে

হজ ফ্লাইটে অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পেরোতে না পেরোতেই এবার খোদ বিমানবন্দরের মূল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আবারও ঝুঁকির আলোচনায় এলো। রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত এ বিমানবন্দরের যাবতীয় অবকাঠামো, চারপাশের পরিবেশ ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ শাহজালালকে ঘিরে ক্রমেই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিচালনার নীতিমালা অনুুযায়ী বিমানবন্দরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে উঁচু ভবন নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অথচ শাহজালাল বিমানবন্দর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বহুতল ভবনের নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা। প্রবেশমুখে নির্মাণ হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেল ও শপিং মল। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যেসব দেশের বিমানপথ রয়েছে, তার মধ্যে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা বিমানবন্দরগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ব্রিটেন। তাতে এ তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বিমানবন্দরটিই বাংলাদেশের ঢাকায়। বিমানবন্দরটিকে কিছু দিন আগে আইকাও সিগনিফিক্যান্ট সেফটি কনসার্নের (এসএসসি) তালিকায় রেখেছিল। দীর্ঘ তিন-চার বছর পর আইকাও শাহজালালকে এসএসসির তালিকা থেকে বাদ দেয়। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর আবার অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিমানবন্দরের সামনের প্রবেশ অংশে বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থার ব্যাপক তৎপরতায় আপাত ‘কঠোর নিরাপদ স্থান’ মনে হলেও বাকি সিংহভাগ অংশই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আছে। সচেতন বাসিন্দারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রকাশ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে ‘বজ  আঁটুনি ফসকা গেরো’ বলেই মন্তব্য করেন। গত কয়েক দিন বিমানবন্দরসহ চারদিকের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষা এলাকা সরেজমিন ঘুরে অরক্ষিত বিমানবন্দরের নানা বেহালচিত্র লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং চার সহস্রাধিক মিটার প্রশস্ত বিরাট আয়তনের এ বিমানবন্দর এলাকার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে অন্তত সাতটি গোপন রাস্তা বানানো হয়েছে। দেয়াল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে আরও পাঁচ-ছয়টি ফোঁকল। সীমানা দেয়ালের নিচ দিয়েও মাটি খুঁড়ে রানওয়ের কাছাকাছি যাওয়ার আরও কয়েকটি গর্ত রয়েছে। তা ছাড়া রানওয়ের পানি অপসারণের জন্য নির্মিত কালভার্টের ভিতর দিয়েও অনেককে অনায়াসে বিমানবন্দরের রানওয়ে ঘেঁষা স্থান পর্যন্ত আসা-যাওয়া করতে দেখা গেছে। সেসব ফোঁকল ও অবৈধভাবে বানানো গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে আপাত দৃষ্টিতে একশ্রেণির যুবককে ভিতরে ঢুকে আড্ডা দিতে ও ছাগল-ভেড়া চড়াতে দেখা গেছে।

আন্তর্জাতিক এ বিমানবন্দরের প্রবেশমুখেই রীতিমতো হাটবাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁর অবৈধ স্থাপনার ছড়াছড়ি। ফুটপাথে ইটের ওপর বিশেষ কায়দায় চুল্লি জ্বালিয়ে নানারকম খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত চলে খোলা আকাশের নিচে, খোলামেলাভাবেই। আশপাশেই গড়ে উঠেছে মোটর গ্যারেজ, গ্যাস মেরামতের নানারকম ব্যবস্থাপনা। দুটি সিএনজি ও পেট্রল পাম্পের অবস্থানও রয়েছে বিমানবন্দর ঘেঁষেই। রানওয়ের অল্প দূরত্বের মধ্যেই গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, বিপজ্জনক স্থাপনা। সীমানা দেয়াল ভেঙে অবৈধভাবে গড়ে তোলা প্রবেশপথ ও ফোঁকল প্রসঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, প্রাচীর ভাঙা-মেরামত, কাঁটাতারের বেষ্টনী নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন অথরিটির। বার বার নিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব গুপ্ত প্রবেশপথ ও ফোঁকলের বিষয়ে লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে সেসব দেয়াল মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করে না। এমনকি ওই গোপন পথগুলোর আশপাশে নিরাপত্তা বাতিও লাগানো হয় না। ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই ঝোপঝাড় বেষ্টিত ওইসব এলাকায় ঘোর আঁধার নেমে আসে। ‘প্রতিটি ফোঁকল পয়েন্টে ডিউটি পোস্ট বানিয়ে রাতদিন পাহারায় রাখা সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে এপিবিএনের ওই কর্মকর্তা জানান, রাতে সেসব স্থানে পুলিশের ভ্রাম্যমাণ টহল টিম ঘন ঘন টহল দেয়। সীমানাপ্রাচীরের স্থানে স্থানে নির্মিত উঁচু পাকা নিরাপত্তা চৌকিগুলোয় রিকশা-ভ্যানের চালকসহ শ্রমিক শ্রেণির লোকজন বিশ্রাম নেয়, আশপাশের যুবকরা গল্প-গুজবের আসর বসায়। তবে দলিপাড়া ও বাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা আকবর হোসেন, মাস্টার আবদুর রহিম, জিন্নত আলীসহ কয়েকজন জানান, প্রাচীরের ওপর শূন্যে বানানো নিরাপত্তা চৌকিগুলোয় দিনের বেলায় বহিরাগত লোকজন আড্ডাবাজি করলেও রাতে মাঝেমধ্যে টর্চলাইট নিয়ে পুলিশ সদস্যদের বসে থাকতে দেখা যায়। বিমানবন্দরসংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম পাশের দলিপাড়ায় সীমানাপ্রাচীরের সঙ্গে খুঁটির ঠেকা দিয়ে বেশ কয়েকটি গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী ইউনুস আলীর খামারে ৩০টিরও বেশি গরু পালন করা হয়। দলিপাড়া থেকে সীমানাপ্রাচীর ধরে বাউনিয়ার দিকে এগোতেই চোখে পড়ে কাঁটাতারের বেড়াশূন্য দেয়াল। কয়েকটি স্থানে ৫০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত জায়গার কাঁটাতারের বেড়া কে বা কারা কেটে নিয়ে গেছে। ফলে সীমানাপ্রাচীরের ওপরে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে অনায়াসে আড্ডা দিতে পারে বখাটেরা। লোকজন অহরহ রানওয়ের আশপাশ পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে এবং ভিতরের ঝোপঝাড়ের কাছে মদ-গাঁজা সেবনের আখড়া বানিয়ে রেখেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেন্দ্রিক অপরাধ ঘাঁটি নিয়ে তথ্যানুসন্ধানকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভুক্তভোগী মানুষজন, বিমানবন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা অভিন্ন তথ্য দিয়ে জানান, মাত্র কয়েক বছরেই বিমানবন্দর এলাকা আমূল পাল্টে গেল। চোখের সামনেই বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকা পরিণত হয়েছে অপরাধের আখড়াস্থলে।

সর্বশেষ খবর