সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিচার বিভাগ নিয়ে হচ্ছেটা কী

আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সব সময় ইতিবাচক সম্পর্ক প্রত্যাশা করে সাধারণ মানুষ। কারণ রাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগ পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মধ্য দিয়েই দেশের সার্বিক কাঠামোকে এগিয়ে নেয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ তিন বিভাগের মধ্যে বিরোধের অবকাশ নেই। এ নিয়ে যে হৈচৈ হচ্ছে, তা কারও পক্ষেই সুফল বয়ে আনবে না। তাই দ্রুত এ সংকট নিরসন করা জরুরি। সহনশীলতা নিয়েই সবাইকে সামনে চলতে হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিচার বিভাগ নিয়ে হচ্ছেটা কী

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। সরকার ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন রাজনীতিক থেকে শুরু করে আইনজীবীরাও। সমর্থকরাও পক্ষে-বিপক্ষে ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সব সময় ইতিবাচক সম্পর্ক আশা করে সাধারণ মানুষ। কারণ রাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগই পারস্পরিক ইতিবাচক সহযোগিতা ও সম্পর্কের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হতে পারে। এর পরিণতি হবে জাতির জন্য ভয়াবহ। তখন মানুষের শেষ ভরসা বলে আর কিছু থাকবে না। তাই এই বিতর্ক এখনোই বন্ধ করা জরুরি। প্রয়োজনে যে কোনো পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা বা আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণের বিকল্প নেই। এ জন্য অযথা হৈচৈ না করে সহনশীলতা দেখানোর আহ্বানও জানিয়েছেন তারা। আইনজ্ঞরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই না বুঝে অযথা হৈচৈ করা হচ্ছে। রাজনীতি করা হচ্ছে। কিন্তু আদালতের রায় নিয়ে রাজনীতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে রায়কে মোকাবিলা করতে হয় আদালতেই, আইনগতভাবে। পেশিশক্তিতে রাজপথে নয়। একটি অংশ মানি আর একটি অংশ মানি না এই প্রবণতাও শুভ নয়। যা মানি না, তা বলতে হবে আদালতে। এরও আইনি পদ্ধতি রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশ ও জাতির স্বার্থেই অন্তত একটি জায়গা রাখতে হবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে, যেন যে কোনো ইস্যুতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সাধারণ মানুষ সেখানে গিয়ে নির্দ্বিধায় বিচার চাইতে পারে এবং ন্যায়বিচার নিয়ে ঘরে ফিরতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে সরকার ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করতে পারে। এর সুযোগ নিতে চাইবে অপশক্তি। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ হলো অভিভাবক। সাধারণভাবে তারাও যেমন রাজনৈতিক ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করবে না, তেমনি বিচার বিভাগ নিয়ে রাজনীতিও কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির কল্যাণে পারস্পরিক শ্রদ্ধা রেখে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

জানা যায়, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, তা ‘অবৈধ’ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় ১ আগস্ট প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট। ওই রায় প্রকাশের পর থেকেই বাদ-প্রতিবাদ চলছে। রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির কড়া সমালোচনা করে আসছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তির কারণে হয়নি’ এমন একটি বক্তব্য এসেছে রায়ে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ‘অবমূল্যায়ন করা হয়েছে’ বলে তাদের অভিযোগ। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও আদালতের ওই পর্যবেক্ষণকে ‘বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রকাশিত রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে প্রসঙ্গক্রমে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনা করেন। ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ের ৫৪তম পৃষ্ঠায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পর্যবেক্ষণের অংশে বলা হয়েছে, ‘কোনো জাতি বা রাষ্ট্র একজন ব্যক্তিকে নিয়ে বা একজন ব্যক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের কথা বলে গেছেন, আমরা যদি সত্যি তা বাস্তবায়ন করতে চাই, আমাদের অবশ্যই আমিত্ববোধের ওই আত্মঘাতী উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে যে কেবল একজন ব্যক্তি বা একজন মানুষই সব করেছে।’

এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করে কোনো কথা রায়ে মোটেও নেই। যেভাবে বলা হচ্ছে স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে বা খাটো করা হয়েছে, সে রকম কোনো বক্তব্য সেখানে নেই। রায়ে শুধু একটি জায়গায় এটি প্রেক্ষিতে এসেছে, একজন ব্যক্তি দ্বারা একটি জাতি বা একটি দেশ গঠন হয় না। এ রকম বক্তব্য কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে না। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বকে এভাবে দেখাটাও সমীচীন নয়। এ রায়ে বরং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশে জাতির জনক বা স্বাধীনতাযুুদ্ধের মহানায়ক তা অনেক বেশি ফুটে উঠেছে এবং স্বীকৃত হয়েছে। যদিও জাতির জনকের স্বীকৃতির কথা একটি রায়ের ওপর নির্ভর করে না। এর পরও যেহেতু বিতর্ক ওঠে, এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলছি, রায়ের এই দিকটায় আওয়ামী লীগ নেতাদের দৃষ্টি দেওয়াটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও সুচিন্তিত হবে। কারণ ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে “জাতির জনক” শব্দটা এসেছে ৩২ বার। প্রধান বিচারপতির রায়ে এসেছে ২১ বার। তিনি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে দ্ব্যর্থহীন শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কমপক্ষে তিনবার। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রায়ের ভিত্তিতে বিতর্ক করার অবকাশ নেই।’ মিজানুর রহমান খান বলেন, বিএনপি এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মিষ্টি খাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে গিয়েছে বলে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা মন্তব্য করছেন। কিন্তু বিএনপির এ অবস্থান খুব একটা সঠিক নয়। কারণ বিএনপি যদি এ রায়কে স্বাগত জানায়, তাহলে জিয়াউর রহমানকে একজন অবৈধ সামরিক শাসক হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে বিএনপি। কারণ প্রধান বিচারপতি তার রায়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলকে অত্যন্ত ক্ষতিকর শাসনব্যবস্থা ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ জন্য রায়ে “বানানা রিপাবলিক” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি কোনো রাষ্ট্রের জন্য মোটেও সম্মানজনক অবস্থান নয়। এটিকে বাদ দিয়ে বিএনপি যে আনন্দের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সেটিরই বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় বলেই আমি মনে করছি।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত আদালতের রায় নিয়ে রাজনৈতিকভাবে দলাদলি বা হানাহানির কোনো অবকাশ নেই। কেননা এর ফলে বিচারব্যবস্থার ওপর দেশের মানুষের আস্থার অভাব দেখা দিতে পারে, যার ফল হবে দেশের জন্য ভয়াবহ। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হলে আইনি প্রতিকারের (রিভিউ) ব্যবস্থা আছে। এ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মতবিরোধ থাকা উচিত নয়। এ রায়ে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আদালত কিছু পর্যালোচনা দিয়েছে। এতে ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। আমি মনে করি রায়ে সরকারের যেসব ব্যর্থতার পর্যালোচনা এসেছে, রায়টি গ্রহণ করে তা সমাধানের পথে এগোলে জাতি উপকৃত হবে। তাদের ভাব-মর্যাদাও জাতির কাছে উন্নত হবে।’

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদারের মতে, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। নানা মহল থেকে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য আসছে। সাধারণ মানুষও বিষয়টি খেয়াল করছে। কিন্তু আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয় এমন অবস্থার দিকে যাওয়া যাবে না। কারণ বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থা তৈরি হলে তা দেশের জন্য মারাত্মক সর্বনাশের কারণ হবে। তিনি বলেন, ‘এ রায়কে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কারও চক্রান্ত সফল হবে না। আমরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ। রায়ের আপত্তিকর অংশ বাতিল বা এক্সপাঞ্জ করা নিয়ে রিভিউ করার বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত হবে। আদালত এটি সুয়োমটোও করতে পারেন। আমরা মনে করি এভাবেই এ পরিস্থিতির সমাধান হতে পারে।’

সর্বশেষ খবর