সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
অভিমত

বিচারপতি খায়রুল যোগ্যতা হারিয়েছেন

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন

বিচারপতি খায়রুল যোগ্যতা হারিয়েছেন

একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি একদা বিচারকের সম্মানজনক আসনে বসেছেন, তার সম্পর্কে অপ্রিয় কিছু বলা, তা সে যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন, আমাদের মতো আইনের শাসনে বিশ্বাসী লোকদের জন্য যে কতটা কষ্টদায়ক সেটা খুব কম লোকই বুঝবেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নিজেই বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জোর গলায় সমর্থন করতে গিয়ে বিচারপতিসুলভ শোভন ভাষাভঙ্গি ত্যাগ করে সমালোচনা করলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতিদের। শান্ত মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারবেন যে অনধিকার চর্চা করতে গিয়ে তিনি নিজেকেই ছোট করেছেন।

প্রথমত, তিনি ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আছেন। এই পদে থেকে তার একসময়ের সহকর্মী বিচারকদের সমালোচনা করা তার ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। হঠাৎ করে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন এবং বিচারকদের অপসারণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের সম্প্রতি যে রায় সেই রায়ের সমালোচনা করলেন।

প্রথমেই তাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে নিজে উদ্যোগী হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার কি দরকার ছিল তার। ল’ কমিশনের এক্তিয়ার হচ্ছে দেশের আইন গতিশীল জীবনের চাহিদা মেটাতে পারছে কিনা তা দেখা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আইন-কানুনে সংশোধন-সংযোজন আনা যাতে আইন-কানুনসমূহ সময়োপযোগী থাকে।

বিচারপতিদের বিচার সম্পর্কিত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ব্যাপারে তিনি যে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে একটি রাজনৈতিক পক্ষ নিলেন এ ব্যাপারে আমরা বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের কাছেই জানতে চাই আত্মপক্ষ সমর্থন করার কি যুক্তি আছে তার? একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে কথা বলছিলেন কিন্তু তাকে মনে হচ্ছিল স্বীয় এক্তিয়ার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসচেতন থেকেই রায়ের বিরোধিতা করছেন। যদিও তিনি ল’ কমিশনের কর্তৃত্ব নিয়ে গর্বের সঙ্গে নিজেকে জাহির করছিলেন। এমনটি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি যে বিশেষ সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন এ সম্পর্কে তার বোধ কাজ করছিল না। যদি তিনি বিচারপতিদের অপরিপক্ব মনে করে থাকেন তবে সেকথা সহজভাবেই বলতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি সেটা না করে নিজের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন সংসদ সদস্যদের প্রতি এবং বললেন, সংসদ সদস্যবৃন্দকে যদি অপরিপক্ব বলা হয় তবে বিচারকদেরও অপরিপক্ব বলা যাবে। কী অপূর্ব যুক্তি! কী অপূর্ব সাবেক প্রধান বিচারপতি। তিনি একজন ধীমান প্রধান বিচারপতি ছিলেন না যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিদের ‘অপরিপক্ব’ বলবেন। তার রায় বাগঙ্মবরতা ও স্ববিরোধিতার কথাই বলবে। যেসব বিচারক যুক্তি দিয়ে রায়টিকে বিশদ ও সর্বসম্মত করে তুলেছেন তাদের তিনি উদারচিত্তে গ্রহণ করতে পারছেন না। এমিকাস কিউরি হিসেবে যেসব প্রখ্যাত আইনজীবী অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেনও ছিলেন এবং তারা সবাই রায়টি সমর্থন করেছেন। তবে কী তাদেরও ‘অপরিপক্ব’ বলতে হবে?

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের ভিতরে এবং বাইরে যে আক্রমণ করা হলো এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর বক্তব্য রাখা হলো সে সম্পর্কে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আদৌ কোনো সমবেদনা দেখালেন না এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। তার জানা উচিত ছিল যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা কোনো সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন না কিংবা কোনো সংবাদ বিবৃতি দিয়ে নিজেদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন না। আহত ও অসম্মানিত হয়ে তারা কেবল রায়ে সাহসের সঙ্গে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন এটা বোঝাতে যে সবকিছু তাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। সমালোচকদের দুর্বলতা সম্পর্কে তারা সচেতন। তবে বিচারপতিদের জনসমক্ষে হেয় না করেও রায়ের সমালোচনা করা যেত।

বড় বড় কথা বলার ব্যাপারে রাজনীতিকদের কোনো জুড়ি নেই। তাদের হাতে রয়েছে পুলিশ। কিন্তু তাদের খোঁজ নিয়ে জানা উচিত যে, জনগণের আস্থা হারিয়ে তারা আজ কতটা খারাপ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছেছে, তাই তারা অবাধ নির্বাচনে বিরোধীদের মোকাবিলা করতে চায় না।

বিষয়টি যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সে সম্পর্কেও বিচারপতি জনাব খায়রুল হক বিন্দুমাত্র সচেতনতা দেখাতে পারেননি। এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ কোথাও বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা ভোগ করছে এমন একটি উদাহরণও তিনি দেখাতে পারবেন না। কোথাও নিম্নকক্ষ — যাকে পার্লামেন্ট বলা হয়, বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা রাখে না।

এই অবস্থায় আমাদের জাতীয় সংসদের দাবি যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে আর কিছুই থাকবে না। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকবৃন্দ সর্বদা সংসদ সদস্যদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকবেন, যারা সর্বাত্মক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। বিচারপতি খায়রুল হকের স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি একজন বাদে সব এমিকাস কিউরির সুপারিশ উপেক্ষা করে এবং অপর তিনজন বিচারপতির ভিন্নমত এড়িয়ে গিয়ে কেবল কাস্টিং ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পরিবর্তে নির্বাচিত সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের রায় দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে সব দল মিলে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল।

এর আগে হাই কোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ বেঞ্চ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে শাসনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে একটি রায় প্রদান করেন। সে রায়টিও বিচারপতি খায়রুল হকের কাছে কোনো মূল্য বহন করেনি। তারপরও তিনি বিচারকদের অপসারণ বিষয়ক ইস্যুতে রায় প্রদানকারী বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করেননি। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সামরিক শাসন আনায়নে সাহায্য করার উদ্দেশ্য আরোপ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। তার চোখে আলোচ্য রায় পূর্ব পরিকল্পিত, অর্থাৎ এই রায়ের কোনো গুণাগুণ বিবেচ্য বিষয় নয়। কোনো প্রধান বিচারপতি বিচার কার্যে এরূপ চক্রান্তের কথা বলতে পারেন না, কারণ রায়টি বর্ণিত হয় যুক্তিতর্ক দেখিয়ে এবং সবার দেখার জন্য এর আবেদন উন্মুক্ত রয়েছে। তিনি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, তদুপরি তার রয়েছে দলীয় প্রণোদনা, এসব কারণে তিনি কিছুটা বেপরোয়া হতেই পারেন। রায় সম্পর্কে যে কেউ আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু আদালত অবমাননার ঝুঁকি না নিয়ে কেউ অসৎ উদ্দেশ্য আরোপ করতে পারে না বা বলতে পারে না বিচারপতিরা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য একযোগে কাজ করেছেন। সুতরাং তিনি জেনেশুনে রাজনৈতিক কারণে আদালত অবমাননা করেছেন।

বিচারপতি খায়রুল হক নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে যে বিশাল রায় প্রদান করেন তার একমাত্র যুক্তি ছিল কেয়ারটেকার সরকার নির্বাচিত সরকার নয়, সরকার হতে হবে নির্বাচিত এটা হচ্ছে শাসনতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো। তাই অনির্বাচিত কেয়ারটেকার সরকার অবৈধ। তার এ কথার কোনো অর্থ হয় না। কারণ, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পূর্ণাঙ্গ সরকার নয়। কেবল অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করাই কেয়ারটেকার সরকারের কাজ।

তিনি রায় দিলেন কিন্তু খুঁজে দেখলেন না অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে কী ধরনের অনুশীলন হয় কিংবা কী ধরনের ব্যবস্থাদি রয়েছে। খোঁজ নিলেই তিনি জানতে পারতেন যে, ভারতসহ অন্যান্য দেশেও প্রথমেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর নির্বাচিত সরকার থাকার প্রশ্ন ওঠে না।

পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার অধীনে সর্বত্র কেয়ারটেকার সরকারের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পার্থক্য কেবল ধরনে, যে দেশ যেমন ব্যবস্থায় আস্থা করে। বিচারপতি খায়রুল হকের রায় ভ্রান্তিমূলক বলে প্রতীয়মান হয়। এ রকম একটি ভুল রায়, যত শিগগিরই সম্ভব বাতিল হওয়া দরকার। জনগণকে ভোটাধিকার বঞ্চিত রেখে কেউ জনপ্রতিনিধি হবার দাবি করতে পারে না।

কী ধরনের পূর্বপরিকল্পনা অথবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারপতি জনাব খায়রুল হক এই উদ্ভট রায় দিয়েছিলেন ভেবে দেখুন, যে রায়ের ফলে বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্তমান পার্লামেন্টকে যথারীতি নির্বাচিত পার্লামেন্ট বলা যাবে না। তারপরও তিনি বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছেন বলে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বিচারক, আইনজীবী অথবা জনগণকে নয়, অন্যদের খুশি করার জন্য ব্যাকুল।

বিচারপতি জনাব খায়রুল হকের কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কিত রায় বর্তমান সরকারকে নির্বাচনে বিজয় অর্জনে সাহায্য করেছিল, যদিও সে বিজয় তার প্রাপ্য ছিল না। এখন এই সরকারের হাতে জাতীয় নির্বাচন বন্দী হয়ে আছে।

তাই বলা যায়, তার রায় গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে এবং প্রশস্ত করেছে স্বৈরশাসনের রায়। ক্ষমতা দখলের নীল নকশা হিসেবে কাজ করেছে বিচারপতি খায়রুল হকের রায়। জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোট গোনা হয় না, পার্লামেন্টে থাকে না কোনো বিরোধী দল। স্বৈরতন্ত্র কায়েমের পথে এখন বাকি রয়েছে কেবল শেষ কাজ সুপ্রিম কোর্টকে পার্লামেন্টের কাছে আজ্ঞাবহ করা। বিচারপতি খায়রুল হক একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজেকে এমন কদর্যভাবে উপস্থাপিত করেছেন যে, তিনি জনগণের নির্বাচনে বিশ্বাস করেন না এবং বিচারকদের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা নেই। বিচারপতি, আইনজীবী বা জনগণের মধ্যে তাকে নিয়ে কোনো গর্ব নেই, স্বাধীন ল’ কমিশনের জন্যও তিনি কোনো উপকারে আসবেন না। তিনি পদত্যাগ করুন আর নাই করুন তিনি যে ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান পদের যোগ্য নন সেটা প্রমাণ করেছেন। এটা চিন্তা করা ঠিক হবে না যে, গোটা জাতি উন্মাদ হয়ে গেছে এবং কোথাও থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না।

সর্বশেষ খবর