সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
অভিমত

সংসদ নিয়ে কি সত্যি কিছু বলা হয়েছে?

শওগাত আলী সাগর

সংসদ নিয়ে কি সত্যি কিছু বলা হয়েছে?

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সবচেয়ে তীক্ষ আক্রমণাত্মক ভাষায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করেছেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা, শিল্পমন্ত্রী  আমির হোসেন আমু। তিনি বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট যদি অবৈধ হয়, তোমার নিয়োগ অবৈধ। তার কারণ এই পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে। সেই রাষ্ট্রপতি তোমাকে নিয়োগ দিয়েছে। তোমার নিয়োগ অবৈধ। তুমি অবৈধ চিফ জাস্টিস।’ একজন প্রধান বিচারপতিকে ‘তুমি’ হিসেবে সম্বোধন করে জনসভায় বক্তৃতা করা কতটা শোভন সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও আমির হোসেন আমুর বক্তব্য থেকে তথ্য মেলে যে, ‘প্রধান বিচারপতি জাতীয় সংসদকে অবৈধ’ বলেছেন। আসলেও কি তাই? প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে কিংবা আদালতের রায়ে কি সংসদকে ‘অবৈধ’ বলা হয়েছে? কিংবা সংসদ সম্পর্কে কোনো অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে?  ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে কোথাও সংসদকে অবৈধ বলা হয়েছে বলে পাওয়া যায়নি। বরং সংসদ এবং বিচারবিভাগের মধ্য সমন্বিত সম্পর্কের তাগিদ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সরকার ব্যবস্থায় সত্যিকার বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগের মধ্যে সত্যিকার অর্থে পৃথকীকরণ সম্ভব না। কাজেই সংসদ এবং বিচার বিভাগ পরস্পরের সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বরং ইতিপূর্বে এই মামলা নিষ্পত্তিকালে হাই কোর্টের কিছু মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে সেগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের প্রতি আদালতের সম্মানবোধেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তা হলে প্রধান বিচারপতি ‘সংসদকে অবৈধ’ বলেছেন কিংবা রায়ে সংসদকে অবমাননা করে মন্তব্য করা হয়েছে— এমন কথাগুলো কোত্থেকে এলো? কারা ছড়াল এই সব কথা? সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই বা কিসের ওপর ভিত্তি করে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন? সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে দেখা যায়, সংসদ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছিল মূলত হাই কোর্টের রায়ে। এই রায়ে (হাই কোর্টের) বলা হয়েছিল ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে, তারা দেওয়ানি মামলায়ও জড়িত। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর বদৌলতে তারা কার্যত উচ্চ আদালতের বিচারকদের ‘বস’ এ পরিণত হচ্ছেন, যা স্বাধীনভাবে বিচার কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রায় ৭০ শতাংশ এমপি ব্যবসায়ী। মাহাবুবে আলম ও মুরাদ রেজা (অ্যাটর্নি জেনারেল ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) দুজনের কেউই এই সংখ্যার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেননি। এসব কারণে, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে উনারা সংসদে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিতর্কে অংশ নিতে অনাগ্রহী। ফলশ্রুতিতে আজকাল সংসদে পাস হওয়া অধিকাংশ আইনই ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের পাওয়া যায়। গুরুত্ব সহকারে সংসদে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে ষোড়শ সংশোধনীর ক্ষমতাবলে তারা এখন বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অদক্ষতা বা অসদাচরণের বিচার করা আইন প্রণেতাদের কাজ না।’

হাই কোর্টের রায়ের পরই এ নিয়ে সংসদে তুমুল আলোচনা হয়েছিল, সংসদ সদস্যরা তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেছিলেন। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের শুনানিতেও এই বিষয়টি এসেছিল। রায়ের মতামত দিতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি জানাচ্ছেন, বাস্তবিক অর্থে সমগ্র বিচার বিভাগের শৃঙ্খলার জন্য কোনো নীতিমালা নেই— যা একটি দেশের জন্য আত্মঘাতী। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টিতে এই বিষয়টি আনা হলে তিনি বলেন, দরকার হলে বিচারকদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এই ঘটনার উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি জানান, অ্যাটর্নি জেনারেল তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন— যোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হাই কোর্টের রায় যে বিচারপতি লিখেছেন, তিনি অধিকাংশ সংসদ সদস্যের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে বলে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। সংসদ সদ্যদের বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ সত্য না হলে বিচারকদের নিয়োককারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার মুখে এই মন্তব্য শোনার জন্য আদালত প্রস্তুত ছিল না। উচ্চ আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধানের আইনে পরিবর্তন আনার নির্বাহী বিভাগের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটা এই বক্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়।

তা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট সংসদ সম্পর্কে হাই কোর্টের অসম্মানজনক বক্তব্যের সমালোচনা করে তা রায় থেকে বাতিল করে দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি হাই কোর্টের মন্তব্যকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, এই মতামতকে আমরা একদমই গ্রহণ করছি না। আদালত বা বিচারকদের সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে এই ধরনের অসম্মানজনক মন্তব্য করা মোটেও উচিত নয়। একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের কোনো ফাইন্ডিংস নিয়ে সংসদের কার্য প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের মন্তব্য করা উচিত না। সংবিধানের ৮৭(২) এবং সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২৭০ ও ২৭১ ধারায় এটি বারণ করাও আছে।

আদালতের রায়ের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে আদালত সংবিধানের কয়েকটি ধারার মধ্যে কনফ্লিক্টকে বিবেচনায় নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মামলার রায়ের নজিরকে বিবেচনায় নিয়েছেন। কিন্তু সংসদ বা সংসদ সদস্যদের নিয়ে আপত্তিকর কোনো মন্তব্য সেখানে পাওয়া যায়নি।  রায় নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তু পক্ষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন, কিন্তু যা বলা হয়নি— তা নিয়ে উচ্চ আদালতকে আক্রমণ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তাও বোধ হয় রাজনীতিকদের ভাবা উচিত।

শওগাত আলী সাগর, টরন্টোর বাংলা পত্রিকা নতুনদেশ এর প্রধান সম্পাদক

সর্বশেষ খবর