সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

১৩ জনের মৃত্যু, আরও বাড়তে পারে। আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ, বড় বন্যার আশঙ্কা

প্রতিদিন ডেস্ক

তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

পানি উঠেছে বাড়িঘরে। সহায়-সম্বল নিয়ে নিরাপদে ছুটছে মানুষ। ছবিটি কুড়িগ্রামের চিলমারীর —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকালও বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়ছিল। ফলে তলিয়ে গেছে নতুন নতুন জনপদ। কোথাও কোথাও বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে অথবা এগুলোতে ধস নেমেছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে থাকায় ব্যাহত হচ্ছে সড়ক ও রেল যোগাযোগ। এদিকে দিনাজপুরে আটজন, লালমনিরহাটে চারজন এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাটে একজন মিলিয়ে মোট ১৩ জন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

বন্যাকবলিত প্রধান জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়া ও নওগাঁ। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের রাঙামাটিতেও বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ- দিনাজপুর : দিনাজপুরে ভয়াবহ বন্যায় একই পরিবারের তিন শিশুসহ আটজনের মৃত্যু হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় ও বানভাসী মানুষ উদ্ধারে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। জানা গেছে, গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টায় কাহারোল উপজেলার ঈশ্বরগ্রামে ভেলা উল্টে একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। ঈশ্বরগ্রাম থেকে কলাগাছের ভেলায় চড়ে পার্শ্ববর্তী বিরল উপজেলার হাসিলা গ্রামে নিজ বাড়িতে তিন সন্তান ও প্রতিবেশীর এক সন্তানসহ আসছিলেন আবদুর রহমানের স্ত্রী সোনাভান বেগম। এসময় ভেলা উল্টে একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। এরা হলো বিরল উপজেলার হাসিলা গ্রামের আবদুর রহমানের মেয়ে চুমকি (১৩), শহিদ আলী (১০) ও সিয়াদ (৭) এবং প্রতিবেশী সাঈদ হোসেনের ছেলে সিহাদ (৭)। অপরদিকে বিরল উপজেলার মালঝাড় গ্রামের বাবলু রায় বলেন, সকালে বাড়ির মালামাল সরাতে গিয়ে পানিতে ডুবে তার স্ত্রী দিপালী (৪৫) মারা গেছেন। এছাড়া দিনাজপুরে বন্যায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে শহরের বালুবাড়ী ঢিবিপাড়া এলাকার এনামুল হকের ছেলে মেহেদী হাসান (১৫) তলিয়ে যাওয়া রাস্তার পাশে খালে পড়ে মারা যান। দিনাজপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর এলাকার আবদুল গফফারের ছেলে আবু নাইম (১৩) বন্যার পানিতে পড়ে মারা যান। এছাড়া সদর উপজেলার দরবারপুর গ্রামের মেহের আলীর ছেলে চাঁন মিয়া (৫৫) আতঙ্কে বন্যার পানিতে পড়ে যান। জামালপুর : জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিয়েছে। গতকাল সকালে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী, চিনাডুলী, কুলকান্দি, সাপধরী, বেলগাছা, নোয়ারপাড়া এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ, চিকাজানী ও চুকাইবাড়ি ইউনিয়নের ৫০ গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে নদীরক্ষা বাঁধের পূর্বপাড় ও চরাঞ্চলের নিচু এলাকার বসতবাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় অনেকে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।

কুড়িগ্রাম : ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১০৮ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমারের পানি বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নীলফামারী : নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্যারাজ এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করে নদীতীরবর্তী মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করেছে প্রশাসন। পানি বৃদ্ধির ফলে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। লালমনিরহাট : তিস্তার পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি ১০৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের বাইপাস ভেঙে যাওয়ায় বিপুল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। লালমনিরহাটের সঙ্গে সারা দেশের বাস ও রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই দুই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ছেন। গতকাল পর্যন্ত জেলার পাঁচ উপজেলার ৩০ ইউনিয়নের ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে ধরলা ও তিস্তার অববাহিকায় রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। গতকাল বিকালে কুলাঘাট ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ুয়া গ্রামে ধরলা নদীতে ডুবে দুটি পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ হয়েছেন আরও তিনজন। মৃত ব্যক্তিরা হলেন পশ্চিম বড়ুয়া গ্রামের মোজাম আলী (৪৫), তার স্ত্রী আসমা বেগম (৩৮), একই গ্রামের আবদুল হামিদ (৩৬) ও তার শিশুপুত্র রিদয় (৯)। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে ওই গ্রামের আরও তিনজন নিখোঁজ হয়েছেন। রংপুর : রংপুরে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমলেও তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। গতকাল ভোরে গঙ্গাচড়া উপজেলায় তিস্তা নদীর মূল বাঁধের ৭০ ফুট ভেঙে যাওয়ায় পানির তীব্র স্রোতে ছালাপাক উপবাঁধের ২০০ মিটার এলাকা ধসে যায়। এতে মর্ণেয়া  ও গজঘণ্টা ইউনিয়নের ৮৭০টি বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঠাকুরগাঁও : গত শনিবার ভোর থেকে দুই দিনের অবিরাম ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তলিয়ে গেছে ঠাকুরগাঁও পৌরশহরসহ পাঁচ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের বাড়িঘর। এ অবস্থায় দুর্গতরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরছেন। শহরের হঠাৎপাড়া, ডিসি বস্তি, সরকারপাড়া ও খালপাড়া, সদর উপজেলার আঁকচা, রায়পুর, মোহাম্মদপুর, সালন্দর, শুকানপুকুরী ও বালিয়াডাঙ্গী, রাণীশংকৈল উপজেলার  আশপাশের অনেক এলাকার বাড়িঘর এখন পানির নিচে রয়েছে। গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র তিস্তাসহ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায়  ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্র্রহ্মপুত্রের পানির চাপে ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়া-রতনপুর, বালাসীঘাটের কাইয়াঘাটসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নওগাঁ : অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আত্রাই ও মান্দা উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আত্রাই নদী ছাড়াও যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। বগুড়া : সারিয়াকান্দি উপজেলার ৫৮টি গ্রামের প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করছে। সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় বানভাসীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৭১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাঙামাটি : হু হু করে বাড়ছে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের পানি। নামছে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলও। ফলে প্লাবিত হয়েছে ১০ উপজেলার কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে গড়ে উঠা পাহাড়ি গ্রামগুলো। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। সড়ক ও কালভার্ট ডুবে যাওয়ায় রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাঘাইছড়ি-বাঘাইহাট-মারিশ্যা ও সাজেক এলাকা। এ অবস্থায় সাজেক ইউনিয়নে আটকা পড়েন প্রায় সাড়ে ৪০০ পর্যটক। অবশ্য গতকাল সকালে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দল পর্যটকদের উদ্ধার করে আনে। খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এখনো পানির নিচে রয়েছে। গতকাল সকালে মাইনি নদীর পানি আরও বেড়েছে। সড়কে পানি উঠায় দিঘীনালা উপজেলার সঙ্গে লংগদু উপজেলা ও মেরুংয়ের যোগাযোগ দুই দিন ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর অনেক সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ। সিলেট : গতকাল সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বন্যায় পানিবন্দী হয়ে আছেন লাখ লাখ মানুষ। কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতে গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও স্থানীয় বাজারহাট তলিয়ে গেছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা থেকে সালুটিকর ও সারিঘাটে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর