মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

পঁচাত্তরের সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের কাহিনী

সাঈদুর রহমান রিমন

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সারা দেশে কারফিউ, সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না তখন একদল দামাল যোদ্ধা অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠেন। তারা অস্ত্র হাতে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে কাঁপিয়ে  তোলেন সীমান্তবর্তী জনপদ।

প্রতিবাদী যুবকরা দলে দলে সমবেত হন ভারতের আসাম ও মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা গারো পাহাড়ে, দুর্গম বনাঞ্চলে। প্রথম দিকে গজারির ডাল কেটে বিশেষ কায়দায় বানানো লাঠিই ছিল তাদের সম্বল— আর ছিল অদম্য মনোবল। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুধুই প্রতীকী মেজাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। জাতির পিতাকে হারানোর শোকে মুহ্যমান একেকজন বীরযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন গেরিলা যুদ্ধে। প্রতিরোধ যোদ্ধারা গারো পাহাড় ঘেঁষা ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলা সীমান্তের বিরাট এলাকা জুড়ে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তারা সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী ৫টি বিডিআর ক্যাম্প এবং দুটি থানা দখল করে বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন সেনাবাহিনীর সঙ্গেও। প্রশিক্ষিত সেনা দলের হেলিকপ্টার, গানশিপ আর সাঁজোয়া বহরের বিপরীতে এমএমজি, মর্টার, এসএলআর নিয়েই লড়াই চালান। একবার  সেনাবাহিনী হটেছে তো অন্যবার পিছিয়ে গেছে প্রতিরোধ যোদ্ধারা। যুদ্ধকালে অন্তত দুই শতাধিক প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ হন। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে ১০৪ জন শহীদ প্রতিরোধ যোদ্ধার নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিরোধ যুদ্ধে ১৪ জন তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশের সদস্য নিহত হন, ক্রসফায়ারে সাধারণ গ্রামবাসীও মারা যান ৩ জন। প্রায় ২২ মাস যুদ্ধ চালিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা টিকে থাকে। কিন্তু ওই সময় রাজনৈতিক নির্দেশনার অভাবে অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রতিরোধযুদ্ধ। পাশাপাশি ভারতে জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের প্রভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শিবিরগুলো একে একে গুটিয়ে নিতে হয়।

প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার চান্দুভূঁই : মেঘালয় সীমান্তের অভ্যন্তরে ঘন বনাঞ্চল আর সারি সারি সুউচ্চ পাহাড় ঘেরা দুর্গম এলাকা চান্দুভূঁইতে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রধান দফতর। সেখানে চিফ কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পুরো প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। সেখানে চিফ ফাইন্যান্স ছিলেন দুর্গাপুর ব্রাহ্মণপাড়া এলাকার গারো আদিবাসী চিত্তরঞ্জন সাংমা। প্রধান রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামারখালীর অধিবাসী আবদুল হক। চান্দুভূঁই পাহাড়ের ঢালে ঢালে তৈরি হয় শ তিনেক ছন-বনের ঘর। সেখানেই কাদের সিদ্দিকীসহ গেরিলা কমান্ডাররা অবস্থান করতেন। চান্দুভূঁইর লোকজন এর আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, শুরুতে মাত্র ৫০০/৬০০ লোকের আনাগোনা দেখা গেলেও ’৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়েই সেখানে ৭/৮ হাজার লোকের বিচরণ দেখা গেছে। এরপরও ছিল আগ্রহী প্রতিরোধ যোদ্ধার ঢল, কিন্তু সবাইকে যোদ্ধা হিসেবে যেমন তালিকাভুক্ত করাও সম্ভব ছিল না, তেমনি সবাইকে আশ্রয় দেওয়ারও উপায় ছিল না। কারণ অর্থ, খাদ্য, আশ্রয়, অস্ত্র- সবকিছুই ছিল সীমিত।

যুদ্ধে জয়জয়কার অবস্থা : যুদ্ধ চলাকালে দুর্গাপুর থানার ওসি ছিলেন তোফায়েল মৃধা এবং কলমাকান্দা থানার ওসি ছিলেন আশরাফ আলী। প্রতিরোধ যোদ্ধারা অভিযান চালিয়ে কলমাকান্দা থানা দখল করে নেন এবং নিজেদের ক্যাম্পে ফেরার সময় ১৯৭৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ওসি আশরাফ আলী ও তার স্ত্রী সুলতানা আশরাফকে আটক করে নিয়ে যায়। ১৯ জানুয়ারি দুর্গাপুর থানা আক্রমণকালে ওসি তোফায়েলসহ ৮ জন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়ে পালান। বাকিরাও হাতিয়ার ফেলে পালিয়ে যান। পরদিনই রংরার সেক্টর কমান্ডার জীতেন্দ্র ভৌমিকের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা অকস্মাৎ হানা দেন বারোমারী ও ফারাংপাড়ার তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্পে। প্রতিরোধ যোদ্ধারা ক্যাম্প দখল করতে সক্ষম হন। এ দুই ক্যাম্প থেকে জব্দকৃত জীতেন্দ্র ভৌমিক বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র জোগান নিয়ে তা প্রতিরোধ যুদ্ধের শক্তি বাড়াতে সক্ষম হন। বারোমারী ও ফারাংপাড়ার দুই বিডিআর ক্যাম্প দখলে রাখা অবস্থায় দিন সাতেক পর বিডিআর পোশাকে সেনাবাহিনী সদস্যরা বাংকার বানিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতিতে যুদ্ধে নামে। তাদের জোগান হিসেবে থাকে হেলিকপ্টার। শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে প্রশিক্ষিত সেনাদের আগে চলো নীতির যুদ্ধ— তবুও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের যেন একচুলও নড়াতে পারছিলেন না তারা। রীতিমতো বাংকার বানিয়ে সুরক্ষিত অবস্থানও নেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। যেখানে কমান্ডারদের নির্দেশ ছিল হয় জয়, নয়তো মৃত্যু। বারোমারী বিডিআর ক্যাম্পে হাবিলদার এবং বিজয়পুর ক্যাম্পের সুবেদার বাদী হয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দুর্গাপুর থানায় পৃথক পৃথক তিনটি মামলা করেন। এতে উল্লেখ করা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আড়াইশ থেকে তিনশ দৃষ্কৃতকারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় এবং সহস্রাধিক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। কলমাকান্দা থানা আক্রমণের ব্যাপার নিয়ে ২৪ জানুয়ারি কলমাকান্দা এবং দুর্গাপুর থানা দখলের ব্যাপারে ২২ জানুয়ারি দুর্গাপুর থানায় আরও চারটি মামলা রুজু হয়।

সেক্টর, সাব-সেক্টর ও কমান্ডাররা : কাদের সিদ্দিকীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে যুদ্ধের জন্য সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয় নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানার ভবানীপুর এলাকায়। ছিটমহল স্টাইলের পাহাড়ি উপত্যকা ভবানীপুরের যে স্থানটিতে সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় সেখানে যাতায়াত করা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে ভবানীপুরের ২০/২২ একর আয়তনের ওই ছিটমহলটুকুতে যেতে হলে ভারতের সীমানা ডিঙ্গিয়ে তবেই যাতায়াত করা সম্ভব ছিল। ফলে দেশের ভিতরে থেকেও বাংলাদেশের সরকারি বাহিনীসহ অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থার প্রায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার এলাকাটি। সেক্টরের জিওসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন টাঙ্গাইলের বাসিন্দা সেলিম তালুকদার। এখানে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন প্রশান্ত কুমার সরকার। কোয়ার্টার গার্ডের অধিনায়ক ছিলেন শরীফুল ইসলাম খান (ধামরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান)। ডিফেন্স কমান্ডার হিসেবে ঘাঁটি করা হয় সোমেশ্বরী নদী ঘেঁষা সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় (বর্তমানে বিজিবির ভবানীপুরের বিওপি), দায়িত্বে ছিলেন সাইদুর রহমান, যিনি এলাকায় মহারাজ হিসেবে পরিচিত। এ হেডকোয়ার্টারের আওতায় বেশ কয়েকটি সাব সেক্টর গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরেই, দুর্গম পাহাড়-অরণ্যে। এগুলো হচ্ছে : নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জ জেলা সীমান্তবর্তী বেতগড়া (কমান্ডার : সুকুমার সরকার), কলমাকান্দা থানা এলাকায় রংরা (কমান্ডার : জীতেন্দ্র ভৌমিক), দুর্গাপুর থানা এলাকায় ভনানীপুর (কমান্ডার : প্রশান্ত কুমার সরকার-বিল্লাবিন), নেলুয়াগিরি (কমান্ডার : সুনীল অধিকারী), ধোবাউড়া থানাধীন দাবরাং (কমান্ডার : দীপংকর তালুকদার), হালুয়াঘাট থানা এলাকার গোবরাকুড়া (কমান্ডার : অতুল সরকার), ঝিনাইগাতি থানা এলাকার উত্তর গজনী। এসব সাব সেক্টরের আওতায় ছোট বড় আরও বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ছিল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের।

সর্বশেষ খবর