মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে জবানবন্দি

কর্নেল সরোয়ার হোসেন মোল্লা (অব.)

১৫ আগস্ট ভোর আনুমানিক ৫টা সাড়ে ৫টার দিকে বন্ধু আনোয়ারুল আলম (শহীদ) টেলিফোন করল। বলল, তোফায়েল আহমেদ তাকে টেলিফোন করেছিলেন। রক্ষীবাহিনীর কিছু লোক নাকি মণি ভাইয়ের বাসায় আক্রমণ করেছে। আমি বিষয়টি শুনে হতবাক হই এবং বলি, সেটা কীভাবে সম্ভব? তারপর মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া উপলক্ষে সাভার থেকে রিক্রুট ব্যাটালিয়নের কিছু সদস্যের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টহল ডিউটির কথা ছিল। উল্লেখ্য, রিক্রুট ব্যাটালিয়নের সদস্যদের সাধারণত এ ধরনের ডিউটি করার কথা নয়। যেহেতু ওই সময় ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর কোনো নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ছিল না, তাই রিক্রুট ব্যাটালিয়নের সদস্যদের আনা হয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পরেই বিষয়টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি এটা রক্ষীবাহিনী নয়। ওরা Armoured corps-এর সদস্য হবে। কারণ তারা কালো ইউনিফরম পরিধান করত। আমি শহীদকে বললাম, তুমি অফিসে আসো, আমিও অফিসে যাচ্ছি। তখন ভোর আনুমানিক ৬টা। গাড়ি আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি হেঁটে রওনা দিলাম। গণভবনের কাছাকাছি এসে দেখলাম আমার গাড়িটা আসছে। আমি গাড়িতে উঠে অফিসে গেলাম। ইতিমধ্যে শহীদও অফিসে এসে পৌঁছেছে। তখন আমাদের অফিসের চারপাশে ধীরে ধীরে ট্যাংক জড়ো হতে থাকে। রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা আসছে। বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরে রক্ষীবাহিনীর একটি টহল ট্রাক সদর দফতরে এসে জানাল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা এটা নিশ্চিত করার পর এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না। আমি আনোয়ারুল আলম শহীদকে নিয়ে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের রুমে বসি। ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান তখন দেশে ছিলেন না। তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর (অব.) আবুল হাসান খানও (হাসান ভাই, তখন অ্যাক্টিং ডাইরেক্টর ছিলেন) অফিসে এসে উপস্থিত হলেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, এখন আমাদের কী করণীয়। এ অবস্থায় আমরা প্রথম টেলিফোন করি রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল কে এন হুদার কাছে। কারণ তিনি ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন আসামি ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান যখন লন্ডন যান তখন এমনিতেই কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, যদি কোনো প্রয়োজন হয় তাহলে কর্নেল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ কর। টেলিফোনে আমরা বিষয়টি কর্নেল হুদাকে জানাই এবং তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি এ ব্যাপারে কী করতে পারবেন? আমাদের লোকজন যারা আছে তাদের বলতে পারি রাজশাহীর দিকে যাওয়ার জন্য যদি তার ব্র্রিগেড আমাদের সঙ্গে থাকে। তার কথাবার্তায় মনে হলো সেই ধরনের অবস্থান তার নেই। বরং উনি আমাদের বললেন, সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বল। সেই অনুযায়ী আমরা সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বললাম। এই কথোপকথন আমরা লাল টেলিফোনে করছিলাম। জেনারেল শফিউল্লাহর কাছে আমরা অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে উনি কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন এবং আমাদের কী করা উচিত সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন কিনা। উত্তরে শফিউল্লাহ বললেন, ‘আমি কর্নেল শাফায়েত জামিলকে পাচ্ছি না।’ শাফায়েত জামিল তখন ৪৬-এর ব্রিগেড কমান্ডার। আমরা বললাম, তাহলে আমাদের কী করণীয়? জেনারেল শফিউল্লাহ বললেন, ‘আমি একটু পরে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’ পরে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে জেনারেল শফিউল্লাহর কথাবার্তায় মনে হলো কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার অবস্থা বা ক্ষমতা তার হাতে নেই। তা না হলে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান তার ব্রিগেড কমান্ডারকে পাবেন না কেন? যা হোক, এরপর আমরা টেলিফোন করলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে। আমি তার সঙ্গে প্রথমে কথা বলি। আমরা পরিচয় দিয়ে বললাম, স্যার, বঙ্গবন্ধু আর নেই। এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আপনি এখন রাষ্ট্রের অস্থায়ী প্রধান। এ অবস্থায় আমাদের জন্য আপনার কী নির্দেশ। ঢাকায় আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ এখানে আমাদের enough troops নেই। আমাদের সবগুলো রেগুলার ব্যাটালিয়ন দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বে নিয়োজিত। সাভারে আমাদের তিনটি রিক্রুট ব্যাটালিয়ন আছে। সাভার রেডিও এখনো সেনাবাহিনী দখল করেনি। আপনি চাইলে আমরা আপনাকে নিয়ে সাভারে যেতে পারি। ওখান থেকে একটা ঘোষণা দিয়ে পদ্মা অতিক্রম করে আমরা ওপারে যাব। আপাতত কুষ্টিয়া বা চুয়াডাঙ্গায় কোথাও অবস্থান নেব। পরবর্তীতে আমাদের যেসব ফোর্সেস চারদিকে ছড়িয়ে আছে তাদের এক জায়গায় আনার চেষ্টা করব। তিনি বললেন, আমি একটু জেনারেল শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলে আপনাদের জানাব। আমি বললাম, স্যার আমরা তার সঙ্গে কথা বলেছি। জেনারেল শফিউল্লাহ কোনো কিছু করবেন কিংবা করতে পারবেন বলে আমাদের মনে হয় না। ঠিক আছে, আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তার কাছ থেকে কোনো উত্তর না আসায় বন্ধু আনোয়ারুল আলম শহীদ তাকে পুনরায় টেলিফোন করে তার সিদ্ধান্ত জানতে চায় এবং এও বলে, সময় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আমি একটু মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিই। ইত্যবসরে আমরাও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে যে কথা বলেছিলাম, উনাকেও একই কথা বললাম এবং আমাদের প্রতি কী নির্দেশনা আছে জানতে চাইলাম। উনি বললেন, আমি সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে আপনাদের জানাচ্ছি। এরপর আবার সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে টেলিফোন করা হলো। এবারও টেলিফোন করল বন্ধুবর আনোয়ারুল আলম শহীদ এবং বলল, স্যার, সময় অতি দ্রুত চলে যাচ্ছে। এদিকে আমরাও আটকা পড়ে যাচ্ছি। কারণ ট্যাংক আমাদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলছে। স্যার, আমাদের এখানে অর্থাৎ হেডকোয়ার্টারে গার্ড ছাড়া আর কোনো ট্রপস নেই। আমাদের ঢাকা ত্যাগ করে সাভারে যেতে হবে। সাভার থেকে ঘোষণা দিয়ে আমাদের পদ্মা অতিক্রম করতে হবে। তিনি শহীদকেও একই কথা বললেন, আমি তো শফিউল্লাহকে পাচ্ছি না। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরে আমরা আবার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম। তখন তিনি আর টেলিফোন ধরলেন না। অন্য একজন টেলিফোন ধরে বললেন, তিনি বাসায় নেই। টেলিফোন রেখে দিলাম। এ অবস্থায় আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না যে, রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে হয়তো কোনো সিদ্ধান্ত আসবে না।

সাত-পাঁচ না ভেবেই আমি এবং শহীদ হঠাৎ করে সাভার রওনা করলাম। শহীদ গাড়ি চালাচ্ছিল। আমি তার পাশে বসা। আমিনবাজার ব্রিজের কাছে আসার পর আমি শহীদকে বললাম, দোস্ত, গাড়িটা থামাও। শহীদ গাড়ি থামাল। হেডকোয়ার্টারে কিছু না বলে কোথায় যাচ্ছি আমরা? যারা হেডকোয়ার্টারে আছে তারা কী ভাববে? আমার মনে হয়, এভাবে কাউকে না জানিয়ে সাভারের দিকে যাওয়া আমাদের ঠিক হবে না। চল আবার হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাই। ওখানে গিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। যা হওয়ার ওখানেই হবে। হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসে একটার পর একটা অপশন নিয়ে আমরা আলোচনা করি। যেহেতু রক্ষীবাহিনী একটি প্যারা-মিলিটারি ফোর্স, সেহেতু দেশের ভাগ্য সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনোটাই আমাদের ছিল না। রাজনৈতিক সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো দিকনির্দেশনা পেলাম না। প্যারা-মিলিটারি ফোর্স হিসেবে আমরা সরকারের সমর্থনে কাজ করতে পারি। তাই রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় আমরা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মনোভাব ছিল অনেকাংশে নেতিবাচক। সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশ ক্যু-এর সঙ্গে জড়িত ছিল। তবে সেনাবাহিনীর বাকি অংশও রক্ষীবাহিনীর যে কোনো উদ্যোগের বিরোধিতা করবে বলে মনে হয়েছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর অসহায়ত্ব দেখে সেই ধারণাই আমাদের হয়েছিল। একসময় ভেবেছিলাম যেহেতু কোনো সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না, তাই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটা গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় কিনা। কিন্তু সেখানেও আমরা চিন্তা করলাম একটা সশস্ত্র বাহিনীর লোক অস্ত্রশস্ত্রসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার ভয় থেকেই যায়। কারণ এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশ রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় Independent war lords সৃষ্টি হবে। সেই গৃহযুদ্ধের পরিণতি হিসেবে হয়তো হাজার হাজার লোক মারা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে যে Independent war lords সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারটিও আমাদের ভাবিত করে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ দেশের মানুষ কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কারণ ওটা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। যদিও হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের সন্তানরা আজও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অতি মানবেতর জীবনযাপন করছে। তবুও স্বাধীনতা-সংগ্রামের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা একটি বিরল গৌরবের বিষয়। এ সত্যটি চিরকাল অনন্য মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হলে যে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে এর কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর থাকবে না। যে কোনো কাজ করার আগে একটা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগোতে হয়। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আমাদের বিবেচনায় খুঁজে পাইনি। পরবর্তী অপশন হিসেবে আমাদের কাছে ছিল ঢাকা ছেড়ে কোনো সীমান্তবর্তী এলাকায় গিয়ে আবার পুনর্গঠিত হয়ে একটা প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করা। কিন্তু রক্ষীবাহিনী এ ধরনের প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করলে সেনাবাহিনী একযোগে যে আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে— এ ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো প্রকার সন্দেহ ছিল না। তখন সেনাবাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি আমাদের থাকবে না। আর সেই অবস্থায় আমাদের অপশন হিসেবে আসবে— ১. হয় আমাদের আবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গণপ্রতিরোধ (Civil resistance) সৃষ্টি করা অথবা ২. সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়া। সীমান্ত অতিক্রম করার ব্যাপারে আমাদের মনে হলো, ১৯৭১ সালে ভারতে গিয়েছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য। সে কারণে তারা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এখন আমরা ভারতে গিয়ে কী করব। শুধু নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে যাওয়া আর ’৭১ সালে ভারত যাওয়া এক কথা নয়। ১৯৭১ সালে আমরা যে সাহায্য পেয়েছিলাম এবারও তা অব্যাহত থাকবে— এমনটা আশা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এখানে আরও একটি বিষয় আমাদের বড় শঙ্কার কারণ ছিল। তা হলো, রক্ষীবাহিনীকে সাহায্য করার নামে আমাদের বাহিনীর সদস্যদের ছদ্মাবরণে যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তবে এ দেশের মানুষ বংশপরম্পরায় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের মীরজাফর হিসেবে গালাগাল করবে। আর রক্ষীবাহিনীর গায়ে কলঙ্কের কোনো প্রলেপ পড়ুক তা আমরা কখনই চাইনি।

সর্বশেষ খবর