বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

৩২ নম্বরের কাছে জঙ্গি নিহত

শোক দিবস ঘিরে ছিল হামলার ছক —আইজিপি

মির্জা মেহেদী তমাল ও আলী আজম

৩২ নম্বরের কাছে জঙ্গি নিহত

সাইফুল

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঠিক ৪২ বছর পর ধানমন্ডির সেই ৩২ নম্বরেই এবার পরিকল্পনা ছিল আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার। আর ভয়ঙ্কর এই হামলার দিনক্ষণ হিসেবে টার্গেট করা হয় সেই শোকাবহ ১৫ আগস্টকেই। ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ভবনের মাত্র ৩০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত একটি আবাসিক হোটেলে সুইসাইডাল ভেস্ট (বোমাসহ বেল্ট) শরীরে বেঁধে আত্মঘাতী হামলার সব প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল সে। কিন্তু আত্মঘাতী জঙ্গির এই আস্তানার সংবাদ পেয়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও সোয়াত সেখানে অভিযান চালায়। সিটিটিসির ‘আগস্ট বাইট’ নামের এই অপারেশনের সামনে টিকতে পারেনি আত্মঘাতী জঙ্গি। মাত্র কয়েক মিনিটেই পরাস্ত হয় সে। সোয়াতের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের একপর্যায়ে নিজের শরীরে বাঁধা সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয় সেই জঙ্গি। আর এর মধ্য দিয়ে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। রক্ষা পায় ৩২ নম্বরের জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান। প্রাণ বাঁচে অসংখ্য মানুষের। গতকাল সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে পান্থপথের ওলিও ইন্টারন্যাশনাল নামের আবাসিক হোটেলে আত্মঘাতী জঙ্গিকে পরাস্ত করার অভিযান শুরু হয়। মুহুর্মুহু গুলি ও বোমার শব্দে গোটা এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আত্মঘাতী বোমাটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, চারতলা হোটেলের পূর্বদিকের রুম বরাবর দেয়াল ভেঙে পান্থপথ রাস্তার ওপরে পড়ে। এ ছাড়া লোহার টানা লম্বা গ্রিলও উড়ে যায়। চারতলার ওই কক্ষটি পরিণত হয় একটি ধ্বংসস্তূপে। নিহত জঙ্গির নাম সাইফুল ইসলাম (২২)। সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, খুলনার ডুমুরিয়া এলাকার ইমাম আবুল খায়েরের ছেলে সাইফুল ইসলাম নব্য জেএমবির সদস্য। পরিবারের কাছে চাকরির কথা বলে সে ঢাকায় আসে। আগে মাদ্রাসায় পড়লেও পরে খুলনার বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ত সে। থাকত শহরের একটি মেসে। একসময় ছাত্রশিবির করত এই সাইফুল। তার বাবাও জামায়াতে ইসলামী করেন।

অভিযানের আগে গত সোমবার রাত ৩টা থেকে ওই হোটেলটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিরাপত্তার কারণে পান্থপথের চৌরাস্তা, আসাদগেট, মিরপুর এলাকার বেশকিছু সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। হোটেল কক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকা ওই জঙ্গিকে বার বার আত্মসমর্পণ করতে বলা হলেও জঙ্গি তাতে সাড়া দেয়নি। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করে যাওয়ার পর সিটিটিসির সদস্যরা হোটেলে অভিযান শুরু করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শোক দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই ৩২ নম্বরে আসবে। এখানে শ্রদ্ধা জানাবে। আমাদের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের গোয়েন্দারা জানতে পারে, এই ৩২ নম্বর কেন্দ্র করে যেসব মিছিল আসবে তাতে আত্মঘাতী বোমা হামলা করা হবে। তারা শত শত লোক মেরে ফেলবে।’ সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নব্য জেএমবি’র একটি সেল বড় নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের সেই পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা আগাম কিছু গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছিলাম। ধারাবাহিক অভিযানে কোণঠাসা নব্য জেএমবি কিছুটা মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, একটি বড় হামলা করা। যাতে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া যায়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সক্ষমতার বিষয়টি প্রচার পায়।’ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার কারণে নব্য জেএমবি নতুন করে সদস্য রিক্রুট করতে পারছিল না। এই হামলার মাধ্যমে তাদের সদস্যরা যাতে আরও বেশি চাঙ্গা হয়, সেই পরিকল্পনাও ছিল তাদের।’

আগাম তথ্য ছিল সিটিটিসির কাছে : ১৫ আগস্ট শোক দিবসের মিছিলে সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের হামলার পরিকল্পনার কথা কয়েক দিন আগেই জানতে পারে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন নব্য  জেএমবির একটি দল নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করছে। এ জন্য চলতি মাসের শুরুতেই ফিদায়ী সদস্য হিসেবে সাইফুল ইসলামকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। চলতি মাসের ৭ আগস্ট খুলনা থেকে ঢাকায় আসে সাইফুল। এরপর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের পর শোক দিবস উপলক্ষে ৩২ নম্বরে হামলার জন্য বলা হয় সাইফুলকে। এ জন্য তাকে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় এক্সপ্লোসিভ। কালো ট্রাভেল ব্যাগে করে এক্সপ্লোসিভ ও সুইসাইডাল ভেস্ট নিয়ে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের ৩০১ নম্বর কক্ষটি ভাড়া নেয় সাইফুল।’

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পান্থপথ এলাকার কোথায় সাইফুল অবস্থান করছে, তা তারা (সিটিটিসি) জানতে পেরেছিলেন। সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে  গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে হোটেল ওলিওতে ওঠার বিষয়টি জানতে পারেন। এ জন্য সোমবার রাত থেকেই পান্থপথ এলাকায় ব্যাপক নজরদারি করা হয়। ভোরের দিকে  হোটেল ওলিওতে সবগুলো কক্ষ তল্লাশি করতে গিয়ে ৩০১ নম্বর কক্ষের বোর্ডার ভেতর থেকে সাড়া না দিলে তাদের সন্দেহ হয়। পরে তারা ওই কক্ষটি বাইরে থেকে সিটকিনি আটকিয়ে রাখেন।’

অভিযান : এক জঙ্গির অবস্থানের তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাত ৩টা থেকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের উল্টোদিকে অবস্থিত ওলিও হোটেল ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা ওই এলাকার প্রতিটি গলি এবং বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়। সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরাও বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে থাকেন। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে হোটেলটি ঘিরে রাখার পর সকাল পৌনে ১০টার দিকে চারতলার পূর্ব পাশের রুমে গুলি ও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। বিস্ফোরণে হোটেলের চতুর্থতলার রাস্তার দিকের অংশের দেয়াল ও গ্রিল ধসে নিচে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের নিচে একজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পুলিশ নিশ্চিত করে ওই যুবক জঙ্গি সাইফুল। অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়। ক্রেনে উঠে সোয়াত সদস্যরা গুলি চালায় হোটেল কক্ষে।

অভিযানে অংশ নেওয়া সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘জঙ্গি নিশ্চিত হওয়ার পর বাইরে থেকে বার বার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় সাইফুলকে। কিন্তু সে ভিতর থেকে কোনো সাড়া দেয়নি।’ সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে  সোয়াত সদস্যরা অভিযানের প্রস্তুতি নিলে জঙ্গি সাইফুল নিজে আত্মঘাতী ভেস্ট পরে বের হয়ে আসে। সোয়াত সদস্যরা গুলি করার সময় সে নিজে আত্মঘাতী হওয়ার জন্য বিস্ফোরণ ঘটায়।’ তারা বলেন, ‘আত্মঘাতী সাইফুলের সঙ্গে তিনটি  বোমা ছিল। প্রথমটি দরজা ভাঙার সময় বিস্ফোরিত হয়, দ্বিতীয়টি সে নিজে ফাটায় ও তৃতীয়টি বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট নিষ্ক্রিয় করে। বোমাগুলো শক্তিশালী ছিল। এ কারণে বিস্ফোরণের সময় রুমের দেয়াল ও ব্যালকনির দেয়ালও  ভেঙে পড়েছে।’

কে এই সাইফুল : সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ‘সাইফুল সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পেয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে অনলাইনে র‍্যাডিক্যাল হওয়ার পর সাইফুলের সঙ্গে নব্য  জেএমবির একটি সেলের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তীতে ফিদায়ী বা আত্মঘাতী সদস্য হিসেবে তাকে নির্বাচিত করা হলে সে ঢাকায় আসে।’ সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নব্য জেএমবি  কোণঠাসা হয়ে গেলেও একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, এমন দাবি কখনো করা হয়নি। এখনো যারা বাইরে আত্মগোপনে রয়েছে, তারা যে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। সংগঠিত হওয়ার পাশাপাশি তারা হামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে।’

৩২ নম্বরে হামলার পরিকল্পনা : আইজিপি : বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিদের ফলো করে আস্তানা আমরা  পেয়েছি। ওলিও একটি খুব সাধারণ হোটেল। হোটেলে তারা অবস্থান নিয়েছে তা আমরা জানতে পেরে তল্লাশি করে যখন  সেখানে গেলাম, তখন যে রেসপন্স পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে সে জঙ্গি এবং আমরা তাকে আটকে রাখি। ওই জঙ্গিকে আত্মসমর্পণ করতে অনেকভাবে বলেছি। কিন্তু সে আত্মসমর্পণ করেনি। পুলিশ বাধ্য হয়ে অপারেশনে গেছে। যখন পুলিশ অপারেশনে গেছে তখন সে একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলে। দরজা ভেঙে  সে আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তখন পুলিশ গুলি করে। তার সঙ্গে সুইসাইডাল ভেস্ট ছিল, ব্যাগপ্যাক ছিল তা দিয়ে সে নিজে আত্মঘাতী হয়েছে। এতে কক্ষের জানালা, বারান্দা উড়ে গেছে। বোঝা গেছে এটি শক্তিশালী বিস্ফোরক। এটা কোনো জনসমাবেশে বিস্ফোরণ হলে বড় ধরনের ক্ষতি ও বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হতো। আমাদের কাউন্টার টেররিজমের গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে এই বিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আগস্ট এলেই আমরা বাড়তি সতর্ক হই। এ মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। সিরিজ বোমা হামলা করা হয়েছে। আরও অনেক ঘটনা। তাই আমরা সতর্ক ছিলাম। এই জঙ্গি নব্য জেএমবির তালিকাভুক্ত কিনা তা তদন্ত করে  দেখতে হবে।’

চাকরির কথা বলে ঢাকায় : নিজস্ব প্রতিবেদক খুলনা জানান,  নিহত সাইফুল ‘জঙ্গি’ ছিল বলে বিশ্বাস করতে চাইছে না তার পরিবার ও গ্রামবাসী। তাদের মতে, ‘দরিদ্র পরিবারের সন্তান সাইফুল খুবই ভালো ছেলে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সাইফুল সবার বড়।

বাবার অনুপস্থিতিতে সে মাঝেমধ্যে মসজিদে ইমামতি করত। তার আচরণে কখনো তাকে জঙ্গি বলে মনে হয়নি।’ জানা যায়, সাইফুলের সঙ্গে সর্বশেষ গত রবিবার মোবাইল ফোনে তার বোন ডুমুরিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী ইরানির কথা হয়। ইরানি পুলিশকে জানিয়েছে, ঢাকায় টিউশনি জোগাড় করে দেবে বলে সাইফুলের এক বন্ধু তাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। টিউশনি করে যে টাকা পাবে তা দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে বলে সাইফুল তাকে জানিয়েছিল। মঙ্গলবার তার বাড়িতে আসার কথা ছিল বলে ইরানি জানায়। গত ৭ আগস্ট খুলনা থেকে বাসযোগে সাইফুল ঢাকায় যায়।

খুলনা পুলিশ সুপার (এসপি) নিজাম উদ্দিন মোল্লা জানিয়েছেন, সাইফুলের বাবা ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়ন জামায়াতের কোষাধ্যক্ষ। তাকে সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হলেও কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ঘটনার পর থেকে তার কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। তার ব্যবহূত মোবাইল ফোনও বন্ধ।

সর্বশেষ খবর