বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
অন্য চোখে

কে খোঁজে কে বোঝে

হানিফ সংকেত

কে খোঁজে কে বোঝে

 

জড় এবং মৃত ছাড়া পৃথিবীর সবকিছুই চলমান অর্থাৎ গতিশীল। আর এই গতিই হলো জীবনের লক্ষণ। উত্থানের যেমন গতি আছে পতনেরও তেমনি গতি আছে। গতির ভালো দিক আছে, খারাপ দিকও আছে।  খারাপ দিকের কারণেই আমরা বলি গতিবেগ সীমিত। আবার বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে খারাপের এই গতিসীমা লঙ্ঘন করলে আমরা বলি পতনোন্মুখ। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় যেখানে গতিবেগ সীমিত সেখানেও সাইনবোর্ডে উল্লিখিত লেখার সঙ্গে তাল না রেখে অতিবেগে ছুটে চলে গাড়ি। ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’, লেখা সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। ‘ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকা’য় চলছে ভিক্ষাবৃত্তি। অনেক দিন আগে ইত্যাদিতে একটি নৃত্য দেখিয়েছিলাম। কোনো নৃত্যশিল্পীর নৃত্য নয়-গাড়ি নৃত্য। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে কখনো ভাঙা রাস্তায়, কখনোবা গর্তে পড়ে গাড়িগুলো যেভাবে দুলতে থাকে, সঙ্গে একটু মিউজিক জুড়ে দিলেই হয়ে যাবে ‘গাড়ি নৃত্য’। আর এই খোঁড়াখুঁড়ির কাজগুলো কেন যেন বর্ষাকালেই বেশি হয়। বর্ষাকালে এসব গর্ত ছুটে চলা নগরবাসীকে বেশ পীড়া দেয়। কিছু কিছু জায়গায় পানি আটকে ছোটখাটো নদীর আকার ধারণ করে। সেখানে নৌকাও চলে। আমাদের নদ-নদী নিয়ে গান, কবিতা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে চমৎকার সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু সেই দৃশ্যটাকে অদৃশ্য করে অন্য এক বৈসাদৃশ্যের দৃশ্য সৃষ্টি হয় বর্ষার অবিরাম বর্ষণে আমাদের এই নগরজীবনে। চলার গতি থেমে যায়, কিন্তু এসব নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বলার গতি বাড়লেও অবস্থা উন্নয়নের গতি বাড়ে না। একজন আর একজনের দোষ দিতে দিতে টকশোর সময়ও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা শেষ হয় না। বলা যায় খোঁড়াখুঁড়ির শহরে জড়াজড়ি করে থাকা সব গর্ত-নালার জ্বালায় অস্থির শহরবাসীর রাশি রাশি বিরক্তিকে কেউ যেন আমলেই নিচ্ছেন না। যানবাহনের সাতকাহন সাতবার নয়, শতবার বললেও সংশোধন হবে কিনা জানি না। আমার প্রসঙ্গ এই যানবাহন বা চলাচল সমস্যা নয়। কারণ ৪ লেন, ৬ লেন, ৮ লেন ও উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচলের জন্য অনেক দৃশ্যমান উন্নতিই হয়েছে, কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমেনি, বরং বেড়েছে। বর্ষায় জলজটে রাস্তাঘাট ডুবছে, ঈদে যানজটে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। সমন্বয়হীনভাবে রাস্তাঘাট খুঁড়ছে। এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের কথা চলছে কিন্তু সমস্যা যথারীতি আমাদের সঙ্গেই অবস্থান করছে। তাই এসব এখন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে এসবই অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এর সঙ্গে আমাদের ভাবমূর্তির বিষয়টি ততটা জড়িত নয়। তবে আন্তর্জাতিক চলাচলের স্থান অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যদি কোনো বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেয় তখন কিন্তু আমাদের ভাবমূর্তির সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এই বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশিরা এ দেশে আসেন। বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা দেখলেই-আমাদের এই সুন্দর দেশটি সম্পর্কে প্রথম দর্শনেই তাদের বিরূপ ধারণা হয়। আমার লেখার বিষয় হচ্ছে আমাদের এই বিমানবন্দরেরই দু-একটি ক্ষুদ্র সমস্যা। রোজার ঈদের পর আমি সপরিবারে আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যে হিউস্টন শহরে গিয়েছিলাম। আর এই সমস্যাটি দৃষ্টিগোচর হয়েছে হিউস্টন থেকে ফেরার পর আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আর সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই এই ক্ষুদ্র লেখার প্রয়াস। হিউস্টনে কাজ শেষে ১৬ তারিখে দেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। হিউস্টন থেকে প্লেন ছাড়ে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। সাড়ে পনেরো ঘণ্টা লাগবে বললেও আমরা দুবাই পৌঁছে যাই এক ঘণ্টা আগেই। ১৭ তারিখ স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে। দুবাইতে ট্রানজিট প্রায় ১০ ঘণ্টার মতো। ফাস্ট ট্র্যাক সুবিধা নিয়ে খুব অল্প সময়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের দেওয়া হলো দুবাই এয়ারপোর্টের কাছেই হোটেল লা মেরিডিয়ানে। পরদিন অর্থাৎ ১৮ তারিখে সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকায় যাওয়ার ফ্লাইট ঊক-৫৮৬। ঢাকা এসে পৌঁছানোর কথা বিকাল সাড়ে ৫টায়। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে পৌনে ১০টার দিকে বিমানে চড়ে বসলাম। আমি, আমার স্ত্রী ও কন্যা— তিনজন মাঝখানে তিনটি আসনে বসলাম এবং বিমানের আইলের পাশে আমার বাম দিকে একজন বিদেশি ভদ্রলোক বসলেন। আমার এই লেখার বিষয়বস্তু এই বিদেশি ভদ্রলোক এবং তার মুখের এক টুকরো হাসি। হাতব্যাগগুলো কেবিনে রেখে সিটে বসে আছি, অপেক্ষা উড্ডয়নের। হঠাৎ করে পাশ থেকে ভদ্রলোক বললেন, ‘এক্সকিউজ মি-ইউ আর ফ্রম’? প্রশ্নটি শুনে অবাক হলাম। কারণ বিমানটি যাচ্ছে বাংলাদেশে, আমি দেখতেও বাংলাদেশি নাগরিকের মতো। সাদা নয় কালো। সুতরাং এ প্রশ্ন কেন? বরং প্রশ্নটি আমারই তাকে করা উচিত ছিল, তারপরও হাসিমুখেই উত্তর দিলাম ‘ফ্রম বাংলাদেশ’। এক কথা দুই কথায় জানলাম ভদ্রলোকও দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ করে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এসেছেন। তিনিও আমাদের সঙ্গে একই হোটেলে ছিলেন। বাংলাদেশে যাচ্ছেন একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে। এক সপ্তাহ থাকবেন। কথাবার্তায় বুঝলাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভদ্রলোকের স্পষ্ট ধারণা নেই। তার কাছে বাংলাদেশ একটি বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভরা দেশ। সবসময়ই এখানে থাকে অশান্ত পরিবেশ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। যে কারণে এ দেশ থেকে প্রচুর লোক বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব শুনে বেশ খারাপ লাগল। এরপর দুবাই থেকে ঢাকা পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথে আমি তাকে বোঝালাম, এ কথা সত্যি- ‘আমাদের দেশে আছে বন্যা-প্লাবন-খরা, আছে দুঃখ-কষ্ট-জরা, তারপরও আমাদের এই দেশ প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা’। আমরা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি, জীবন দিয়েছি। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা গর্ব করে বলতে পারি- ‘ধন্য আমি ধন্য, এই দেশ আর এই মানুষের জন্য’। আমাদের দেশে রয়েছে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি। দেশের সব মানুষ একাত্ম হয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করি। আমাদের দেশের রূপ-বৈচিত্র্যের কোনো তুলনাই হয় না। মোটামুটি তাকে বুঝিয়ে দিলাম তুমি যাই শুনে থাক না কেন- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। আমার কথা শুনে লোকটি খুব উদ্দীপ্ত হলো এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তার পুরনো ধারণা পাল্টে গেল। এরপর আমার পরিচয়, আমার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পরিচয় পেয়ে খুশি হলেন। এর মধ্যে আমার কন্যার সঙ্গেও গল্প জুড়ে দিলেন। গল্পগুজবে কখন যে ৪-৫ ঘণ্টা পার হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। অবশেষে এমিরেটস দেশের মাটি স্পর্শ করল। অন্যরকম আনন্দে মনটা ভরে উঠল। বিমান স্থির হতেই নামার আয়োজন। বিমান থামা এবং নামার সময় এক অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলাম। মানুষ দীর্ঘ সময় বিমানে বসে থাকেন কিন্তু থামার সঙ্গে সঙ্গেই নামার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেন বুঝি না। এই হুড়োহুড়িটা হিউস্টন থেকে দুবাই আসার ফ্লাইটে ছিল না কিন্তু দুবাই থেকে ঢাকা আসার ফ্লাইটে এই চিত্রটি লক্ষ্য করলাম। যাই হোক আমরা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার এই ভদ্রলোক একই সঙ্গে বিমান থেকে নামলাম। প্রতিটি যাত্রীর হাতেই ২-৩টি করে হাতব্যাগ বা হ্যান্ড লাগেজ। এই ভদ্রলোকেরও দুটি লাগেজ, একটি কেবিন ব্যাগ আর একটি দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে কেনা বিভিন্ন জিনিসে ভরা ব্যাগ। মনে হচ্ছে বেশ ভারী। ব্যাগের হ্যান্ডেল ধরে চাকায় ভর করে অধিকাংশ যাত্রীই তাদের লাগেজ নিয়ে অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জ অর্থাৎ ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে যাচ্ছেন। করিডর দিয়ে কিছুদূর হেঁটে গেলেই ডানদিকে এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) এবং সিঁড়ি রয়েছে। ওখান থেকে নামলেই নিচে ইমিগ্রেশন কাউন্টার। দূর থেকে লক্ষ্য করলাম ওই সিঁড়ির মুখে কিসের একটি জটলা। লোকজন দ্রুত অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জের দিকে যাওয়ার সময় ওখানে এসে থমকে দাঁড়ালেন। কাছে গিয়ে জটলা সৃষ্টির রহস্যটা বুঝলাম। অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জের একমাত্র চলন্ত সিঁড়িটি অচল অর্থাৎ বিকল বলে চলছে না। যার যার লাগেজ হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে। তাই কেউ বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরে, কেউ বা দুই হাত দিয়ে উঁচিয়ে লাগেজ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। কেউ বা নামতে গিয়ে ঘামছে। দীর্ঘ বিমান যাত্রার পর ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রীদের এই অবস্থা দেখে খারাপই লাগছিল। হঠাৎ বিদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞাসা করলাম নামছেন না কেন? বলল, একসঙ্গে দুটো ব্যাগ নিয়ে নামা কঠিন, তাই একটা নামিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। মনে মনে ভাবলাম এই লোকটিকেই আমি বলেছিলাম- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’, হাসির রহস্যটা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। হাজার হাজার কোটি টাকার দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে দেশব্যাপী কিন্তু যেখানে এসে বিদেশি নাগরিকরা প্রথম দেশের চিত্র দেখবেন সেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একমাত্র এসকেলেটরটির এই অবস্থা কেন? উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ক’টাকাইবা খরচ হতো এই এসকেলেটরটি ঠিক করতে? হয়তো একসময় ঠিক হবে কিন্তু এই বিদেশি যাত্রীরা আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্পর্কে কী ধারণা নিয়ে গেলেন? এসব প্রশ্নের জবাব বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে আছে কিনা জানি না। এখানেই শেষ নয়, সিঁড়ি বেয়ে নেমে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে লাগেজ সংগ্রহ করতে গেলে অনেকেই লাগেজ ট্রলি সংকটে পড়লেন। অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় বিমানবন্দরে এসব ট্রলি থাকে। অধিকাংশ ট্রলিই পুরনো এবং বেশকিছু ট্রলি আবার চলে না। এরপর লাগেজের জন্য অপেক্ষমাণ অনেক যাত্রীই খোঁজেন রেস্টরুম বা বিশ্রামাগার। অনেক যাত্রী লাগেজ সংগ্রহের স্থানে যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত সেই রেস্টরুমে যান। রেস্টরুমের কাছাকাছি গিয়েই অনেককে নাকে হাত চাপা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখলাম। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি অসম্ভব দুর্গন্ধ। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর কোথাও বিমানবন্দরের টয়লেটে এতটা দুর্গন্ধ আছে কিনা আমার জানা নেই। আন্তর্জাতিক হলেও আমাদের বিমানবন্দরটি উন্নত দেশের বিমানবন্দরের মতো হবে না সেটা মেনে নিলেও, ছোট ছোট এসব উদাসীনতা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ এসব কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, এ বিদেশি ভদ্রলোকের মতো আমাদের দেশে একটি সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করতে এসে বিমানবন্দরে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন বিমানবন্দরে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে। কারণ তার লাগেজটি কাটা হয়েছিল। কাটা লাগেজে চুরির চাইতেও বড় চিন্তা ছিল সেখানে যদি কেউ কোনো নিষিদ্ধ জিনিস ঢুকিয়ে দিত তাহলে কী অবস্থা হতো? বিমানবন্দরের দুর্দশা এবং ভোগান্তির চিত্রের কথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে সেটার গতি এতটাই বেড়ে যায় যা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুযোগ-সুবিধা ও যাত্রীসেবার মান বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ও ভালো বিমানবন্দরের একটি তালিকা প্রকাশ করে ‘The Guide to Sleeping in Airports’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম এশিয়ার সবচেয়ে খারাপ ১০টি বিমানবন্দরের মধ্যে ৯ নম্বরে আছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২০১৬-তেও সেই একই অবস্থানে আছে এ বিমানবন্দরটি। কেন এ বিমানবন্দরটি খারাপ সেই কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে— এখানে ইমিগ্রেশনের জন্য, লাগেজের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। টার্মিনালের সব খানেই বিশৃঙ্খলা। প্রতিষ্ঠানটি আমাদের বিমানবন্দর সম্পর্কে যাত্রীদের মন্তব্য তুলে ধরে লিখেছে, এটি একটি বিশৃঙ্খল বিমানবন্দর (chaotic Airport). অনেক যাত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘Filthy and poorly maintained restrooms. Facilities are outdated and not up to international standards.’ (বিশ্রামাগারটি অত্যন্ত নোংরা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় এবং সুযোগ-সুবিধাগুলোও সেকেলে আর আন্তর্জাতিক মানের নয়।) হঠাৎ করে মনে হলো এ বিদেশি ভদ্রলোক যদি আমাদের বিমানবন্দর সম্পর্কে ওই প্রতিষ্ঠানে কোনো মন্তব্য লেখেন- কী লিখবেন? প্রতিষ্ঠানটিকে দেখে মনে হচ্ছে এটি যেন যাত্রীদের জন্য একটি সংসদ অর্থাৎ তাদের কথা বলার জায়গা। অনেক যাত্রীই এ বিমানবন্দরে তাদের দুর্ভোগের চিত্র ফেসবুকে, ইউটিউবেও দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ কি তাও দেখেন না? এসব দেখে মনে হয় কারোই যেন কোনো দায় নেই। আর দায় থাকবেই বা কেন-এর জন্য জবাবদিহিতা বা শাস্তির কোনো নজির নেই। অথচ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আমরা সবাই ভাবমূর্তি নিয়ে খুব চিন্তিত, অথচ সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে এ উন্নয়ন কর্মটুকু করা যাদের দায়িত্ব তারা কেন এত উদাসীন তা বুঝতে পারছি না। এসকেলেটরের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ওই বিদেশি ভদ্রলোক যে উপহাসের হাসি দিলেন সেটা আমি কখনো ভুলতে পারব না। আর সে কারণেই এ ছোট্ট লেখা। জানি না এতে কাজ হবে কিনা। আমরা মাঝরাতের টকশোগুলোতে অনেক কথা শুনি, যারা সবাই জ্ঞানীগুণী। কিন্তু কারও কারও চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তিনি কেন, কী উদ্দেশ্যে কী বলবেন। এদের কাছ থেকে তেমন কোনো নতুন সত্য এবং তথ্য পাওয়া যায় না। জনগণের দ্বারা-জনগণ থেকে-জনগণের জন্য প্রতিনিধি পাওয়ার একমাত্র উপায় নির্বাচন। নির্বাচন এলেও আমরা অনেক কথা শুনি। প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায় কিন্তু জলজট-যানজট নিয়ে যেমন কথার জট খোলে না, তেমনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও কদিন পরই শ্রুতি থেকে উধাও হয়ে যায়। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে বললেন, Make sentence with the word ‘realise’ (অর্থাৎ ‘রিয়্যালাইজ’ শব্দটি দিয়ে বাক্য গঠন কর)। একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে উত্তর দিল- God has given us the ‘real eyes’ to ‘realise’ the ‘real lies’ (সৃষ্টিকর্তা আমাদের ‘প্রকৃত চোখ’ দিয়েছেন ‘প্রকৃত মিথ্যে’ অনুধাবন করার জন্য)। so think twice and get wise-(সুতরাং আরেকবার ভাবুন এবং বিচক্ষণ হোন)। আসলে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আর সেটা হতে হবে সদিচ্ছা। একটি বচন রয়েছে, ‘প্রথমে দর্শনদারি-তারপরে গুণ বিচারী’। সুতরাং প্রথম দর্শনেই যদি কারও দোষ পেয়ে কেউ দোষ ধরেন তখন সেই দর্শকের কোনো দোষ দেওয়া যায় না। বিমানবন্দরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা দেখে মনে হয় এসব খোঁজার কেউ নেই, বোঝারও কেউ নেই। লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর