বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

মধ্যাঞ্চলে ধেয়ে আসছে বন্যা

মৃত্যু ১০৭ জনের, মিলছে না পর্যাপ্ত ত্রাণ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মধ্যাঞ্চলে ধেয়ে আসছে বন্যা

পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা। গাইবান্ধার ফুলছড়ির হঠাৎপাড়া গ্রামে গতকাল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বন্যা এবার দেশের মধ্যাঞ্চলে ধেয়ে আসছে। ২১ আগস্ট অমাবস্যায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধির পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যা স্থিতিশীল থাকলেও বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে পানি বিপদসীমা রেকর্ড ছাড়িয়ে প্লাবিত করছে চারপাশের এলাকা। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়ায় পানি ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে মানিকগঞ্জ-শরীয়তপুরের দিকে বন্যা ধেয়ে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১০৭ জন মারা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, ‘ধরলা, তিস্তার পানি কমলেও যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উত্তরাঞ্চলে কমলেও পানি বাড়বে মধ্যাঞ্চলের দিকে।’

১৯৮৮ সালের ইঙ্গিত : উজানের ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও তিস্তা অববাহিকায় পানির উচ্চতা ৭৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ১৯ আগস্টের মধ্যে ওই পানি বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় (ইউএনআরসিও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ গবেষণা কেন্দ্র। ১০ আগস্ট সংস্থাটির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভুটান ও নেপালের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অঞ্চলগুলোয় গত শুক্রবার থেকে পানি বাড়ছে এবং ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এ পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে পারে। ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উজানে বন্যার মাত্রা সবচেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। ভারত ও চীনের অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে বিপদসীমা অতিক্রম করছে নদ-নদীগুলো। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা রেকর্ড অতিক্রম করেছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি ঢুকতে পারছে না। ফলে পানি এক রাস্তা দিয়ে বের হতে গিয়ে চাপ বাড়ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বন্যায় উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ২০ জেলা প্লাবিত হয়েছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুলেটিনে বলা হচ্ছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি ব্রহ্মপুত্র নদের উজানের অংশে (কুড়িগ্রাম, রংপুর) উন্নতি হতে শুরু করবে। আর জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জে অবনতি হবে। বন্যা পরিস্থিতি মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করার আশঙ্কা রয়েছে। গঙ্গা অববাহিকার পানি বৃদ্ধি পেলেও তা বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকার চারদিকে ৫টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ১৩৬-১৩৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

অমাবস্যার জোয়ার : আগামী ২১ আগস্ট অমাবস্যা ঘিরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে সৃষ্ট জোয়ারে পানি ঢুকবে নদ-নদীগুলোয়। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান বা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকা পানির সঙ্গে জোয়ারের পানি যোগ হলে বন্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি যদি একযোগে বাড়ে এবং জোয়ারের পানি এর সঙ্গে যোগ হলে ১৯৮৮ সালের চেয়েও বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তবে পদ্মার পানি বাড়ার আগেই যদি ব্রহ্মপুত্রের পানি কমে যায় তাহলে বন্যা পরিস্থিতি ১৯৮৮ সালকে অতিক্রম করবে না। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের শিক্ষক ও পানি বিশেষজ্ঞ নঈম গওহর ওয়ারা বলেন, ‘১৯ আগস্ট পর্যন্ত বন্যার পানি বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এদিকে ২১ আগস্ট অমাবস্যায় জোয়ারের পানি নদ-নদীতে ঢুকবে কিন্তু এর আগে নদ-নদীর পানি নেমে না যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। ফলে ক্রমবর্ধমান পানি মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদীসহ আশপাশের এলাকাগুলোকে প্লাবিত করবে।’ এদিকে ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোয় পানি বাড়তে শুরু করেছে। বিপদসীমার নিচে থাকলেও বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গার পানি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানের অবস্থা জানিয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। যমুনার নলীন পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৬ ও কালিহাতীর যোগাচর পয়েন্টে ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ঝিনাই নদীর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের নওগাঁ-জসিহাটি বেড়িবাঁধ ভেঙে নওগাঁ, জসিহাটি, তারটিয়া, তীরঞ্জ, ফুলকী, ময়থা গ্রামসহ অন্তত ৩টি উপজেলার ২০ গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কালিহাতী উপজেলার হাতিয়া-লৌহজং নদীরক্ষা বাঁধ ভেঙে অন্তত ১০টি গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে।

জামালপুর : জামালপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সকালে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। যমুনার ভাঙনে দেওয়ানগঞ্জের বরখাল এলাকার শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ৫ হাজারের বেশি পুকুরের মাছ। এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে বকশীগঞ্জের মালিপাড়া গ্রামে মোজাম্মেল নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া দুপুরে মেলান্দহ উপজেলার ভালুকা গ্রামে বন্যা দেখতে গিয়ে মেলান্দহ উমির উদ্দিন হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সজীব ও জিল্লুর পানির প্রবল তোড়ে ভেসে গেছে। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে লাল মিয়া নামে এক পথচারীও পানিতে ডুবে নিখোঁজ রয়েছেন। বন্যায় রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে জামালপুর-তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতু রুটে ট্রেন চলাচল। বিভিন্ন স্থানে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে জামালপুর-মাদারগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জেলার ৮১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যা প্লাবিত হয়েছে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সরকারি দফতর। এ অবস্থায় দেওয়ানগঞ্জ ইউএনও অফিসের কার্যক্রম চলছে চুকাইবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে।

ফুলপুর (ময়মনসিংহ) : মালিঝি নদীর পাড় ঘেঁষে চানপুর থেকে পলাশকান্দা যাওয়ার পথে আফসার ও আইনলের বাড়ির মাঝখানে রাস্তা ভেঙে প্রায় ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে মসজিদ, মাদ্রাসা, বাড়িঘর ও বাজার তলিয়ে গেছে। সব বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। একই অবস্থায় রয়েছে ভাটপাড়া, বালিচান্দা, কান্দাপাড়া, কুটুরাকান্দা, চানপুর, পুরাপুটিয়া, বড়পুটিয়া ও সঞ্চুরগ্রাম।

নীলফামারী : ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও সৈয়দপুরের অনেক এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দী। চার দিন ধরে পানিবন্দী রয়েছেন সৈয়দপুরের পাটোয়ারী পাড়া, বসুনিয়া পাড়া, কুন্দল, নয়াবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ। তবে পানি কিছুটা কমায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে ফিরতে শুরু করেছেন বানভাসি মানুষ। ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়দের সহায়তায় কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। রবিবার খড়খড়িয়া নদীর পাটোয়ারী পাড়া ও বসুনিয়া পাড়ার দুটি স্থানে সৈয়দপুর শহররক্ষা বাঁধে ধস নেমেছিল।

লালমনিরহাট : তিস্তার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলার পানি এখনো বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তা-তীরবর্তী গ্রামগুলোয় পানি নামতে শুরু করলেও ধরলার অবস্থা রয়েছে অপরিবর্তিত। ধরলা-তীরবর্তী লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ৫টি, আদিতমারী উপজেলার ১টি ও সদর উপজেলার ২টিসহ মোট ৮টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ ৮টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। হাজার হাজার মানুষ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদিকে দীর্ঘ ৩৫ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল থেকে ঢাকার সঙ্গে লালমনিরহাটের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে।

গাইবান্ধা : নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৪২টি ইউনিয়ন এবং গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধা শহররক্ষা বাঁধের ডেভিড কোম্পানি পাড়া, চকমামরোজপুর, কাজলঢোপ এলাকার ৮টি পয়েন্ট একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার রাতে পানিতে ডুবে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউনিয়নের তালুককানুপুর গ্রামের রিয়ামণি নামে আড়াই বছরের এক শিশু মারা গেছে। সে ওই গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে।

বগুড়া : যমুনার পানি বেড়ে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত ৩ উপজেলা সারিয়কান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের ৯১টি গ্রামে পানি উঠেছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে পানির প্রবল চাপে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ১০টি স্থান হুমকির মুখে পড়েছে। বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দির কুতুবপুর, দিঘলকান্দি, চন্দনবাইশা ও ধুনটের পুকুরিয়া ভাণ্ডারবাড়ী, বড়ইতলি, বানিয়াজান, শিমুলবাড়ী ও আটাচর এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পানি চুইয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা মাটি, বাঁশ দিয়ে পাইলিং করে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

দিনাজপুর : দিনাজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, চলতি ভয়াবহ বন্যায় ১৩ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় সাড়ে ৫ লাখের অধিক গবাদিপশু হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ বন্যায় গোখাদ্যের জন্য ৩৪৮ একর জমির কাঁচা ঘাস ও ১ হাজার ৬৬৬ মেট্রিক টন খড় বিনষ্ট হয়েছে। এ কারণে দিনাজপুর জেলায় গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

কুড়িগ্রাম : পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২৪ দশমিক ৭৭, ব্রহ্মপুত্র নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৭ দশমিক ২৮, তিস্তা কাউনিয়া পয়েন্টে ২৮ দশমিক ৯৮ ও ধরলা পয়েন্টে ২৭ দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্র জানিয়েছে, ৯ উপজেলার ৬২ ইউনিয়নের ৮২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪০ কিলোমিটার। পানিবন্দী রয়েছেন ৪ লাখ ২২ হাজার মানুষ। ৪২ হাজার ৩৫১ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাড়ে ১০ হাজার মানুষ। ভেসে গেছে ২৩টি ব্রিজ ও কালভার্ট। বানভাসি ২৫ হাজার পরিবার ৪০৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কুড়িগ্রাম জোনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজস্ব অর্থায়নে বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে। জেলা ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক লীগ পৌর কমিটির আহ্বায়ক আবদুর রহিমের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে পৌর এলাকার বানভাসি ১১০০ পরিবারের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

জয়পুরহাট : জয়পুরহাটের সদর, পাঁচবিবি, ক্ষেতলাল, আক্কেলপুর ও সদর উপজেলার কমপক্ষে ৫১টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। কৃষি বিভাগের উপপরিচালক সুধেন্দ্রনাথ রায় জানিয়েছেন, ‘জেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ও শাক-সবজির খেত তলিয়ে গেছে।’ জেলা প্রশাসক মোকাম্মেল হক জানিয়েছেন, ‘ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। ইউনিয়নগুলো থেকে চাহিদা মোতাবেক বিতরণ করা হবে।’

বদরগঞ্জ (রংপুর) : বদরগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে দুলাল মিয়া (৪৫) ও হৃদয় (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সকালে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বুজরুক বাগবাড় ও কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট গাছুয়াপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। দুলাল মিয়া মুঠো জাল নিয়ে বানের পানিতে মাছ ধরতে গেলে স্রোতে তলিয়ে যান। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল এলাকাবাসীর সহায়তায় তার লাশ উদ্ধার করে।

নওগাঁ : আত্রাইর পানি বিপদসীমার ২০০ ও ছোট যমুনার পানি ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নওগাঁর ছোট যমুনায় অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে বন্যার পানি। নওগাঁ শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছোট যমুনার পানি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আউটলেট দিয়ে প্রবেশ করে শহর প্লাবিত হয়েছে। এতে জেলা প্রশাসক, জেলা দায়রা জজের বাসভবনসহ বাঙ্গাবাড়িয়া, বিহারি কলোনি, উকিলপাড়া, কালীতলা, সুপারিপট্টি মহল্লা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রধান সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পত্নীতলা, বদলগাছী, ধামইরহাট, রানীনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থান ভেঙে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে আত্রাই উপজেলা ও নাটোর জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বাঁধ ভেঙেছে মান্দা উপজেলায়। বন্যার পানিতে নওগাঁর ৬ উপজেলার লক্ষাধিক বিঘার ফসলি জমি তলিয়ে গেছে এবং কয়েক হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

নাটোর : সিংড়ায় আত্রাইর পানি বৃদ্ধিতে চলনবিল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দুই দিনে আত্রাই ও চলনবিলে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্রাইর পানি বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তীরবর্তী এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। মহেশচন্দ্রপুর মহল্লায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

ফরিদপুর : সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত ১২ ঘণ্টায় পদ্মার পানি ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এখন তা বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ফরিদপুর সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। তলিয়ে গেছে কয়েক শ হেক্টর জমির নানা প্রজাতির ধানসহ সবজি। বেশ কয়েকটি স্কুল-মাদ্রাসায় পানি ওঠায় সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

নোয়াখালী : নোয়াখালী পৌর এলাকাসহ জেলার বেগমগঞ্জ, সদর, সেনবাগ, চাটখিল ও সোনাইমুড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। জেলা শহরের অধিকাংশ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। অফিস-আদালত, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ায় জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। এদিকে ২০-২১ দিন ধরে বেগমগঞ্জের শরীফপুর ইউনিয়নের উত্তর খানপুরসহ ৯টি ওয়ার্ডে পানিবন্দী হয়ে আছেন ৪০ হাজার মানুষ।

শরীফপুর ইউনিয়নের উত্তর খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় পানি ঢুকে পড়েছে।

সর্বশেষ খবর