শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতি এখন দুর্লভ পেশা

৭০ শতাংশ এমপির পেশা ব্যবসা, রাজনীতিবিদরাও এমপি হয়ে ব্যবসায় নামেন, ছাত্র যুব শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও বাদ নেই, এমনকি বাম-ডান সবাই ঝুঁকছেন ব্যবসায়, মাঠ থেকে কেন্দ্র সব একই চিত্র

রুহুল আমিন রাসেল ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

দুর্লভ পেশায় পরিণত হয়েছে রাজনীতি। একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিবিদরা গৌরবের সঙ্গে পেশা হিসেবে পরিচয় দিতেন রাজনীতি। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমান সংসদের এমপির ৭০ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী। একসময়কার অনেক পেশাদার রাজনীতিবিদও সরাসরি বিভিন্নভাবে ব্যবসা করছেন। আবার নামে-বেনামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তারা ব্যবসায় সম্পৃক্ত আছেন। মাঠ থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একই অবস্থা। এমনকি ডান-বাম সব ধরনের নেতাই ঝুঁকছেন ব্যবসার দিকে। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলে যোগ দিচ্ছেন ব্যবসার জন্যই। ছাত্র-যুব সকল পর্যায়ের রাজনীতিতে একই চিত্র।

আবার এমপি হওয়ার পরই পাল্টে গেছে কারও কারও পেশাও। আগে ব্যবসা না করলেও এমপি হয়েই জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসার সঙ্গে। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগে রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন জনসাধারণের কল্যাণে। আর এখন সবাই রাজনীতিতে জড়ান নিজেদের কল্যাণে। অনেকেই রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছেন।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দশম জাতীয় সংসদের এমপির প্রায় সবাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকে নিজেদের হলফনামায় রাজনীতিবিদ উল্লেখ করলেও বাস্তবে তারা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। কেউ কেউ ব্যবসায়ী পরিচয় না দিলেও নিজের ও পরিবারের নামে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমপিরা নিজেদের ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রায় সবার আয়ের মূল উত্স হচ্ছে ব্যবসা। ৩৫০ জন এমপির হলফনামা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, হাতে গোনা কয়েকজন এমপি ছাড়া প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। শতকরা হিসাবে শুধু ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা দাঁড়ায়  ৬২ দশমিক ২৮ শতাংশে। তবে সংরক্ষিত আসন বাদ দিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশে। আয় বিশ্লেষণ করে পেশা নির্ধারণ করা হলে এ সংখ্যা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিন পৃথকভাবে কথা বলেছে।

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘আমি তো যারা রাজনীতি করেন, তাদের যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দেখি। তারা সম্মানীয় পদে আছেন। তারা যেভাবেই আসুন না কেন, জনগণের প্রতিনিধি। তাই রাজনীতিবিদদের খাটো করে দেখি না।’

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘কংগ্রেস বা পাকিস্তান আমলে যারা রাজনীতি করতেন, তাদের অধিকাংশই আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিকই ব্যবসায়ী। তারা রাজনীতি করছেন ব্যবসায় কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতে।’ তিনি বলেন, ‘আবার অনেকেই শখের বশে রাজনীতিতে জড়িয়ে ব্যবসায়ী হয়ে যান। আগের আর এখনকার রাজনীতিকদের মধ্যে অনেক তফাত। এটা দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, খালি চোখেই দেখা যায়। আগেকার রাজনীতিকরা রাজনীতি করতেন জনসাধারণের কল্যাণে। আর এখন সবাই রাজনীতিতে জড়ান নিজেদের কল্যাণে।’

খালেকুজ্জামান : বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে আসলে সমাজের চালিকাশক্তি। একটা সমাজ কোন ধরনের নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে চলবে এবং গোটা শাসন ও অর্থব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সবকিছু আবর্তিত হয় রাজনীতিকে ঘিরে। ফলে রাজনীতি যদি নীতি ও আদর্শবর্জিত হয়, তা পুরো জাতি ও রাষ্ট্রকে লক্ষ্যচ্যুত করে ফেলে। জনগণের প্রত্যাশা মার খেতে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতি থেকে নীতি যত বিসর্জন হবে, ততই সেখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে। তাতে দুর্বৃত্তদের হাতে রাজনীতি চলে যাবে। ক্ষতিও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকে একদল লোক ব্যবসা হিসেবে নেবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে এখনো যুবশক্তির আগ্রহ আছে। যেহেতু প্রধান রাজনৈতিক ধারা এবং বিগত ৪৬ বছর যারা দেশ শাসন করেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন, সেখানে গণতন্ত্রের পরিবর্তে পরিবারতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন সংকট উত্তরণের পথ হলো নীতি-আদর্শের ওপর রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা, যারা ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে পণ্যে পরিণত করবেন না। সে ধরনের রাজনৈতিক শক্তি, সংগ্রাম ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে রাজনীতিতে যুবসমাজের আগ্রহ বাড়বে।’

মাহমুদুর রহমান মান্না : নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘প্রথম কথা হলো রাজনীতি তো রাজনীতি, ব্যবসা নয়। রাজনীতি করে ক্ষমতা পেলে ব্যবসা করা যায়, অর্থ আয় করা যায়। রাজনীতি মানে রাজ্যের নীতি। যারা রাজ্য, রাষ্ট্র ও দেশকে একটা ভালো কিছু দিতে চাইবেন, কিছু করতে চাইবেন, তারা রাজনীতিতে আসবেন। কিন্তু ব্যবসায়ী যারা রাজনীতিবিদ হয়েছেন, তারা আসলে রাজনীতিবিদ হননি। তারা বুঝতে পারেন যে রাষ্ট্রক্ষমতার দাপট কতখানি। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যবসায় করতে চান। এজন্য এখন রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে বেশি। ফলে মানুষের কল্যাণ ও দেশের প্রগতিশীল উন্নয়ন করার চিন্তা মার খায়। তাই তো দেখা যায় উন্নয়ন উন্নয়ন করে চিৎকার করা হচ্ছে, আবার দেশ বানের পানিতে ভাসছে। অথবা পুরো দেশ জলাবদ্ধ হয়ে আছে। অথবা নতুন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ হচ্ছে না। এক কথায় বললে, ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন ব্যবসার মুনাফার ভিত্তিতেই তারা দেশ চালান। এতে কিছু লোকের পকেট ভারী হয়। লুটপাট অবাধ হয়ে যায়, কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ হয় না।’

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা ঠেকায় পড়ে ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছেন। টাকা দেখাতে না পারলে মনোনয়ন পাওয়া যায় না। নেতা-কর্মী লালন-পালন না করতে পারলে, তাদের কাছে অবস্থান থাকে না। সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে ধস নেমেছে। এ সংকটের সহজ সমাধান হলো রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো দলগুলো রাজনীতির আদর্শ থেকে সরে গেলেও বাম দলগুলো এখনো সে আদর্শ ধরে রেখেছে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দলগুলোর ভিতরে এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে বাজার অর্থনীতি চলছে। এ দলগুলোয় রাজনীতিকরা ব্যবসায়ী হচ্ছেন আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিক হচ্ছেন।’

হায়দার আকবর খান রণো : সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রণো বলেন, ‘এখন রাজনীতিবিদরা হয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। এটা সুস্থ রাজনীতির জন্য মোটেই শুভ নয়। দুশ্চিন্তার বিষয়, উদ্বেগের কারণ।’ তিনি বলেন, ‘আগে পাকিস্তান আমলে যারা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তাদের সমাজে একটা মর্যাদা ও সম্মান ছিল। কারণ তারা দেশের জন্য কাজ করেন। এখন রাজনীতিবিদ বলতে সে রকম লোক আছেন, কিন্তু সংখ্যায় তারা অনেক কম। বেশির ভাগ সংসদ সদস্য অথবা মন্ত্রী পেশাগত রাজনীতিক নন। তারা ব্যবসা করেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করেন। এমন লোকেরা আজকে রাজনীতির ময়দান দখল করে বসে আছেন। এতে রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। সমাজে অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আগে রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, তা হারিয়ে গেছে। আগে জেলখানায় যাওয়া ছিল সম্মানের ও গৌরবের বিষয়। এখন জেলখানায় যাওয়া মানে দুর্নীতির বিষয়। কারণ এখন দুর্নীতির কারণেও রাজনীতিবিদরা জেলখানায় যাচ্ছেন। রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।’

সর্বশেষ খবর