শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

দরকার না হলে নির্বাচনে সেনাবাহিনী নয় : সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দরকার না হলে নির্বাচনে সেনাবাহিনী নয় : সিইসি

কোনো দল বা কারও চাওয়া-না চাওয়ায় আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করেই একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’ এ ছাড়া তিনি জানিয়েছেন, ‘ভোটে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে “সমঝোতা”য়  নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই।’ গতকাল গণমাধ্যম প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপে প্রশ্নোত্তরে এ কথা জানান সিইসি। এদিকে সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ, প্রার্থীর হলফনামা এনবিআর ও দুদকের মাধ্যমে বাছাই, ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রে টিভি ক্যামেরা স্থাপন, ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও নির্বাচনী আইন সংস্কারে বড় ধরনের সংশোধন না করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সকাল ১০টার পর ইসির সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো সংলাপে বসে ইসি। দুপুর ১টা পর্যন্ত মতবিনিময় চলে। এ সময় নিজেদের মতামতের পাশাপাশি প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন সিইসি। চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব উপস্থিত ছিলেন। সংলাপ শেষে প্রশ্নের জবাবে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন ইসির সিদ্ধান্তে হবে। কেউ চাইবে-না চাইবে তার ওপর হবে না। পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি মনে করি, সবাই আসবে। দরকার মনে না করলে সেনাবাহিনী আসবে না।’ এটা সম্পূর্ণভাবে ইসির ওপর ছেড়ে দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি জানান, ‘রাজনৈতিক দলের সংলাপে শুধুই আলোচনা হবে, কারও আসা-না আসার বিষয়ে কোনো আলোচনা হবে না। আমরা যে ডায়ালগ করব পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে, এটা শুধু ডায়ালগ। তাদের কথা শুনব, আমাদের কথা তারা শুনবে। এ নিয়ে কে আসবে, না আসবে তা নিয়ে আমাদের কোনো ইস্যু থাকবে না।’

চাপের মুখে পড়লে কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এর সুযোগ নেই। কারও কাছে যদি আমরা আত্মসমর্পণ করি তাহলে এটা আমাদের দুর্বলতা। এটা আমরা করব না। কারণ, আমাদের কারও কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ ইসি ‘সম্পূর্ণ স্বাধীন’ ও ইসির পরিচিতি ‘স্বাধীন সত্তা’ বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো চাপের মুখে পড়ার প্রয়োজন নেই। চাপের মুখে পড়ব না। এই যদি আমাদের শপথ থাকে, এটা যদি আমাদের অঙ্গীকার থাকে তাহলে চাপের মুখে আমরা কখনো কমপ্রোমাইজ করব না; নতিস্বীকার করব না। ইটস্ এনাফ, আর কোথাও যেতে হবে না। এবার আর কোথাও যাব না, এটা আমার অঙ্গীকার। এজন্য আপনাদের সাক্ষী রেখেই এ কথাগুলো বলছি।’

সব দলকে নির্বাচনে আনতে ‘মধ্যস্থতার’ ভূমিকা নিতে গণমাধ্যমের সুপারিশের বিষয়ে ইসি কি কোনো পদক্ষেপ নেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘আমার মনে হয় না আমি নিতে চাই না। এ বিষয়ে আমি একমত নই। আমি নির্বাচন করব। আমরা সবাই ভুলে যাই, অনেক আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মেডিয়েটর এসে আমাদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সমঝোতায় আসতে পারেননি। সেখানে আমি কেন চাইব রিস্ক নেওয়ার জন্য, অযথা সময় নষ্ট করার জন্য? এটা আমার কাজ নয়। ভেরি ফার্মলি— এটা আমার কাজ নয়।’

ভোটের মাঠে সমান সুযোগ নিশ্চিতের তাগিদ সাংবাদিকদের : সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন টিভি, অনলাইন ও রেডিওর প্রধানরা। সেই সঙ্গে বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। গতকালের সংলাপে ২৬ জন অংশ নিয়েছেন। এতে অধিকাংশই বলেছেন, নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। কে ভোটে অংশ নিল বা না নিল তা রাজনৈতিক বিষয়। সম্ভব হলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাধিকবার মতবিনিময় করা যেতে পারে। যেসব দল ভোটে থাকবে তাদেরসহ সব প্রার্থীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে। পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকেও রাখতে হবে মাঠে। অযথা সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে আগাম ‘বিতর্ক’ থেকে বিরত থাকারও পরামর্শ এসেছে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। সংলাপে উপস্থিত ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, শাইখ সিরাজ, মোজাম্মেল বাবু, আমীর খসরু, খায়রুল আনোয়ার, হাসনাইন খুরশিদ, মোস্তফা ফিরোজ, জ ই মামুন, খালেদ মহিউদ্দীন, ফাহিম আহমেদ, সৈয়দ আশিক রহমান, রাশেদ চৌধুরী, তুষার আবদুল্লাহ, রেজোয়ানুল হক রাজা, তালাত মামুন, মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।

গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান, আইন, বিধিবিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আইনি প্রয়োগ ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে সবার প্রশংসা পাবে কমিশন। নিরপেক্ষভাবে আইন-সংবিধানের ভিতরে থেকে কাজ করতে হবে। সব দলকে আলোচনা, ঐকমত্য, সংলাপের দরকার নেই। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে আপনাদের। কে এলো না এলো তা দেখার বিষয় নয় ইসির। এ ছাড়া ভোটের দিন ইসির নিজস্ব ওয়েবে দ্রুত ও সঠিক ফলাফল প্রচার এবং দেশের ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

অনেকে বলেছেন, ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি কমিশন ভোটের সময় তাদের মোতায়েনের প্রয়োজন মনে করে তাহলে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে নিয়োজিত করবে। এ ছাড়া ইসির কাছে পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দলগুলোর আস্থা চূড়ান্তভাবে অর্জন সম্ভব হবে না; তবে জনগণের আস্থা অর্জনে সব পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে দলের সঙ্গে সিরিজ সংলাপ, ৩০০ আসনে একাধিক দিনে ভোট ও ধর্মীয় দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে গঠনতন্ত্র সংশোধন ও নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ এসেছে সংলাপে।

গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের প্রস্তাব : সংলাপ শেষে ইসির সম্মেলন কক্ষে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সার্বিক বিষয়ে একীভূত মতামতগুলো তুলে ধরেন। তা হলো : ১. সেনা মোতায়েনে পক্ষ-বিপক্ষে মত রয়েছে; অধিকাংশই সেনা মোতায়েনের বিষয় ইসির ওপর ন্যস্ত করেছে। ২. ‘না ভোট’ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি মত এসেছে। ৩. নির্বাচনী পর্যবেক্ষক নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন। ৪. ভোট কেন্দ্রে এনআইডি লাগবে না, এটা নিশ্চিত করা। ৫. ভোটে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করা। ৬. টিভি চ্যানেল ও সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ। ৭. প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া। ৮. ভোটের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৯. প্রার্থীর হলফনামা এনবিআর-দুদকের মাধ্যমে যাছাই করা। ১০. ভোটার অনুপাতে আসন বণ্টন। ১১. স্বাধীনতাবিরোধীদের নিবন্ধন না দেওয়া ও নিবন্ধিতদের কার্যক্রম নিরীক্ষা করা। ১২. ভোটের ফলাফল দ্রুত ও সঠিকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা। ১৩. সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৪. পরাজিত প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৫. একাধিক দিনে ভোট আয়োজন। ১৬. প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ১৭. সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৮. ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা এখনই প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া। ১৯. অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘন ঘন সংলাপ। ২০. সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও নির্বাচনী আইন সংস্কারে বড় ধরনের সংশোধন না করা। সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, ২৪ আগস্ট রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া শুরু হবে। সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো সংলাপের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তুলে ধরা হবে। সংলাপ পর্ব শেষে সবার প্রস্তাব একীভূত করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন।

সর্বশেষ খবর