শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

৪০০ দখলদারে জিম্মি খাল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় ঢাকা। কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমর ছুঁই ছুঁই। রাজধানীর ভিতরের ও চারপাশের খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে খালের জায়গা। ঢাকা জেলা প্রশাসনের তৈরি দখলদারের তালিকা ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে ৪০০ দখলদারের তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকা মহানগরীতে বিদ্যমান খালের সংখ্যা ৪৩। সব খালের মালিকানা ঢাকা জেলা প্রশাসনের। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৬টি। ঢাকা জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৮টি খাল। এ ছাড়া রাস্তা, বক্স কালভার্ট, ব্রিক সুয়ার লাইনের মাধ্যমে বিকল্পভাবে পানি নিষ্কাশনের জন্য রয়েছে আরও ৯টি খাল। তবে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঠেলাঠেলি চলে ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে।

সরেজমিন দেখা যায়, নন্দীপড়া-ত্রিমোহনী খালের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বাজার। বাজার পার হয়ে খালের খোঁজে গিয়ে দেখা মেলে সারি সারি দোকানের। পানের দোকান থেকে শুরু করে মাইকের দোকান কোনটা নেই? খালের গলা চিপে ধরে তৈরি করা হয়েছে বহুতল ভবন। এখন চলছে এগুলো কেনাবেচাও। যাত্রাবাড়ীর ধলপুর খাল থেকে উৎপত্তি হয়ে মান্ডা, রাজারবাগ, নন্দীপাড়া মৌজার ভিতর দিয়ে নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী সড়কের পাশ ঘেঁষে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে নাসিরাবাদ-নন্দীপাড়া খালের সঙ্গে ত্রিমোহনীতে মিলিত হয়েছে এ খাল। আবর্জনা ও বর্জ্যে এরই মধ্যে সেটি ভরে গেছে। খালের ওপর ঘর তুলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। অন্তত ১৮০ জন মিলে দখল করে নিয়েছেন খালটি। এর মধ্যে হাশেম মেম্বারের কাপড়ের দোকান, হানিফের সবজির দোকান, শাহ আলমের কাপড়ের দোকান, খোকা মিয়ার বাসা, বাচ্চুর গ্যারেজ, নন্দীপাড়া মসজিদ, সবজির দোকান (বারেক, আতাউর, জাহাঙ্গীর, ছালাম, মাইদুল, মুসলেম মিলে দিয়েছেন), আবুল হাশেমের মাছের দোকান, নন্দীপাড়া মহিলা ক্লাবের পক্ষে ফার্মেসি, জাতীয় পার্টির স্থানীয় কার্যালয়, নন্দীপাড়া যুবসংঘের পক্ষে মুদি দোকান, মিছির আলীর গ্যারেজ, নন্দীপাড়া ক্রীড়া সংঘ; এ ছাড়া জেলা পরিষদ মার্কেট এবং মসজিদ কমিটির পক্ষে অর্ধশত দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। কাটাসুর খালে কবরস্থানের জন্য কমপক্ষে ১০ বিঘা জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালে প্রায় ৩০ একর জায়গা দখল করে কয়েকটি হাউজিং কোম্পানি স্থাপনা তৈরি করেছে। এ ছাড়া খালের ৩.২৪ একর জায়গা দখল করে কবরস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। কাটাসুর খালের ১ নম্বর মৌজার আরএস ১৯৬১ দাগে ০.৬১ একর বালু দিয়ে ভরাট করেছেন আবদুর রশিদ শিকদারের ছেলে ইউসুফ শিকদার। এ খালের সুলতানগঞ্জ মৌজায় ১ নম্বর খতিয়ানে আরএস ৯২ ও ৯৩ নম্বর দাগে রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী কলেজসহ ৩৪ ব্যক্তি মিলে খাল দখল করে নিয়েছেন। কামরাঙ্গীর চর খালে টিনের ছাপরা তৈরি করে অবৈধ দখল বহাল রেখেছেন কামাল উদ্দিন, মোসলেম উদ্দিন, ইসমাইল, কামাল মেম্বার, পান্না ব্যাটারির এমডি লোকমান হোসেন (টিনের ছাপরা, পানির ট্যাঙ্ক, দুটি ফুটওভার ব্রিজ, টিনশেড ঘর) ও তাইজ উদ্দিন। কালুনগর খালে বহুতল ভবন, টিনশেড ঘর এবং সেমিপাকা ভবন তুলে দখল করা হয়েছে খালের অধিকাংশ জায়গা। ঢাকার খালগুলো এখন স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের কব্জায়। তারা রীতিমতো খালগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে সেখানে বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্র বসিয়েছেন। এই দখলদারদের ২০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তালিকা তৈরির প্রায় আট মাস পার হলেও এখনো বেদখল রয়ে গেছে খালগুলো। তালিকা তৈরির পরই তা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেও পাঠানো হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উচ্ছেদে এখনো নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। ঘোপদক্ষিণ খালেরও এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সে স্থানে বর্তমানে লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস অবস্থিত। ইবরাহিমপুর খালেরও একই অবস্থা। দুই পাড়েই অবৈধ স্থাপনা তুলে দখল করা হয়েছে। ইবরাহিমপুর কালভার্ট এলাকায় অবস্থিত ঢাকা ওয়াসার পাম্প হাউসের পাশে খালের দক্ষিণ পাড় দখল করে টিনশেড ও আধাপাকা ঘর তোলা হয়েছে। আবার পাশেই আরেক অংশ ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। রূপনগর খালের কয়েকটি অংশে অবৈধ দখল রয়েছে। আর অধিকাংশ জায়গাই বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে। চিকন নালায় পরিণত হয়েছে খালটি। বাইশটেকি খালের মাঝামাঝি একটি বড় আকারের পাকা ভবন রয়েছে। সেখানে খালটি মোটে ৮ ফুটে টিকে আছে। মহাখালী খালের নাখালপাড়া পাগলার পাড় ব্রিজসংলগ্ন ও বায়তুস সালাম জামে মসজিদের একটি অংশ দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া নিকেতন ২ নম্বর স্লুইসগেট-সংলগ্ন স্থান মাটি ফেলে ভরাট করে দখল করা হয়েছে। কাগজে-কলমে কল্যাণপুর প্রধান এবং কল্যাণপুর ক, খ, ঘ, ঙ, চ খাল— এ ৬টি খাল রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর বাসাবো, মান্ডা, মেরাদিয়া-রামপুরা খালেও অবৈধ দখলদার রয়েছে। শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিই যে খাল দখল করেছে তাই নয়, আছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও। কাটাসুর খাল দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড ও গরুর হাট বসানো হয়েছে। নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ ইজারার মাধ্যমে একটি মার্কেট করে ২৬টি দোকান নির্মাণ করেছে। একই খালের ওপর ২০টি দোকানের আরেকটি মার্কেট করেছে ঢাকা জেলা পরিষদ। পরীবাগ খালটি শাহবাগ মোড় থেকে বেগুনবাড়ী খালে মিশেছে। খাল হিসেবে অধিগ্রহণ হওয়ায় এর ওপর দিয়ে রাস্তা করেছে সরকার। আর পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু আশপাশে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনার কারণে এ খালের পানি খুব একটা নিষ্কাশিত হয় না।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর