সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফায়ারিং স্কোয়াডে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ২০০০ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়

আদালত প্রতিবেদক ও গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

ফায়ারিং স্কোয়াডে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড

রায় ঘোষণার পর গতকাল আসামিদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় ১০ আসামিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি এক আসামিকে যাবজ্জীবন ও তিন আসামিকে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া তিন আসামিকে গুনতে হবে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা। গতকাল ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম এ রায় ঘোষণা করেন। এ ছাড়া মামলার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় ১০ আসামিকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায়ের আদেশে বলা হয়েছে, হাই কোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে গুলি করে ১০ আসামির দণ্ড কার্যকর করা হোক। তবে আইনজীবীরা জানান, এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও বিচারিক আদালত ফায়ারিং স্কোয়াডে দণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আপিল বিভাগের আদেশের পর পাঁচজনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে ফাঁসির দড়িতে। সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ২৫ আসামির মধ্যে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে অন্য একটি মামলায়। এ কারণে তার নাম এ মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। মুফতি হান্নান বাদে বাকি ২৪ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— ওয়াসিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে রাশেদুজ্জামান ওরফে শিপন, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, আবু বক্কর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মো. ইয়াহিয়া, আবদুর রউফ ওরফে মুফতি আবদুর রউফ ওরফে আ. রাজ্জাক ওরফে আবু ওমর এবং পলাতক ইউসুফ ওরফে মোহসাব মোড়ল, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আবদুল হাই। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাবন্দী মেহেদী হাসান ওরফে আবদুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী। আর ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে থাকা আনিসুল ইসলাম আনিস ও মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান এবং পলাতক সারোয়ার হোসেন মিয়া। এ ছাড়া অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন কারাবন্দী আরিফ হাসান সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা সাব্বির, মাহমুদ আজহার এবং পলাতক কামাল উদ্দিন সাকের, মুন্সী ইব্রাহিম, মো. শাহনেওয়াজ ওরফে মো. আজিজুল হক, মো. লোকমান, শেখ মো. এনামুল হক, মিজানুর রহমান ও আবুল হোসেন ওরফে খোকন। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ লুত্ফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের জন্য মঞ্চ নির্মাণের সময় মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া যায়। পরদিন ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার করা হয় কোটালীপাড়ার হেলিপ্যাড থেকে। এর এক দিন পর নিজের নির্বাচনী এলাকায় দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত ওই কলেজ মাঠে জনসভায় শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক নূর হোসেন বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা করেন। ঘটনা তদন্ত করে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমান ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গোপালগঞ্জের আদালত রাষ্ট্রপক্ষের ৪১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে। পরে ২০০৯ সালের ২৯ জুন নতুন করে নয়জনকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে মামলা দুটি ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা : এদিকে একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় নয়জনকে ২০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত। গতকাল একই আদালতের বিচারক এ রায় ঘোষণা করেন। কারাদণ্ড পাওয়া নয়জন হলেন— ইউসুফ ওরফে মুসা ওরফে আবু মুসা (পলাতক), আনিসুল ইসলাম ওরফে আনিস, মেহেদী হাসান ওরফে আবদুল ওয়াদুদ ওরফে মেহেদী হোসেন ওরফে গাজী খান, ওয়াসিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ, মাহমুদ আজহার ওরফে মামুনুর রশীদ, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে শিমন খান, শাহনেওয়াজ ওরফে আজিজুল হক ও শেখ মো. এনামুল হক (পলাতক)। এ ছাড়া এ মামলায় চারজন খালাস পেয়েছেন। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, মুফতি আবদুল হান্নান আফগানিস্তানে মুজাহিদ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং সেখানে তিনি তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। দেশে ফিরে তিনি হুজি-বি নামক সংগঠনের সদস্য হন। তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য গোপালগঞ্জের বিসিক এলাকায় অবৈধভাবে সোনার বাংলা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি সাবানের কারখানা স্থাপন করা হয়। ওই কারখানায় আসামিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সাবান তৈরির কাঁচামাল আনার আড়ালে আসামি মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী আসামিরা বোমা তৈরির উপকরণ কারখানায় এনে রাখতেন। প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আসার কথা শুনে মুফতি হান্নানসহ আসামিরা সাবান কারখানায় শক্তিশালী বোমা তৈরি করেন। এরপর ২০০০ সালের ১৯ জুলাই সাবান কারখানার গাড়িতে করে কোটালীপাড়া এলাকায় নিয়ে রাতের আঁধারে তা পুঁতে রাখেন। এ দুই মামলার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সরকারি কৌঁসুলি খোন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, এ রায়ে তারা আংশিক সন্তুষ্ট। যারা খালাস পেয়েছেন তাদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী হত্যা চেষ্টা মামলার রায়ে খুশি গোপালগঞ্জবাসী : জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলার রায়ে গোপালগঞ্জবাসী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য, সাফল্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে জীবন দিয়ে হলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রাণ রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন। মামলার বাদী কোটালীপাড়া থানার তত্কালীন এসআই নূর হোসেন সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন চান তিনি। কোটালীপাড়া উপজেলার বদিউজ্জামান সরদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেঁচে আছেন বলেই তিনি বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহর কাছে আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব আলী খান রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং দ্রুত রায়ের বাস্তবায়ন আশা করেন। জেলা পরিষদ সদস্য নজরুল ইসলাম হাজরা মন্নু সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, কোটালীপাড়ায় কোনো জঙ্গি সন্ত্রাসীর ঠাঁই হবে না। আমরা জঙ্গিবাদকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করব। জীবন দিয়ে হলেও প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করব। কোটালীপাড়া পৌরসভার মেয়র এইচ এম অহিদুল ইসলাম বলেন, এ রায়ে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। এ মামলায় আমি সাক্ষ্য দিয়েছি। রায়ে খুশি হয়েছি। কোটালীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, রায়ে আমরা খুশি। রায় দ্রুত কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করে তাদের সাজা কার্যকর করতে হবে। উল্লেখ্য, বিগত ২০০০ সালের ২২ জুলাই কোটালীপাড়া শেখ লুত্ফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় ২টি দূর নিয়ন্ত্রিত বোমা পুঁতে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ।

সর্বশেষ খবর