বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গো য়ে ন্দা কা হি নী ৬

একটি সিমকার্ডেই ধরা জোড়া খুনের খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

একটি সিমকার্ডেই ধরা জোড়া খুনের খুনি

রাজধানীতে ঘটে যাওয়া একটি জোড়া খুন নিয়ে তোলপাড় সারা দেশে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ঘুম হারাম। ক্লুলেস এই জোড়া খুনের খুনিদের শনাক্ত করতে পারছে না পুলিশ। তদন্তে একযোগে কাজ করছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে তিন দিন। কিন্তু খুনি আটক হয়নি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ঝানু সব গোয়েন্দা খুনি শনাক্তে নানা কৌশলে এগোচ্ছেন। খোয়া যাওয়া নিহত ব্যক্তির মোবাইল ফোনটিও বন্। খুনিরাও তেমন কিছু ফেলে যায়নি ঘটনাস্থলে। ঘটনার তিন দিনের মাথায় হঠাৎ সেই মোবাইল নম্বর খোলা পান গোয়েন্দারা। সেই ফোনে কল করে কৌশলে গোয়েন্দারা কথা বলেন। ট্রাকিং করে পুলিশ জানতে পারে ফোনটি মিরপুরে ব্যবহার করা হচ্ছে। কথা বলতে বলতেই গোয়েন্দারা পৌঁছে যায় মিরপুর এলাকায়। কিছু সময় পর একদম সেই মোবাইল ফোনের সামনে। একটি ফোন ফ্যাক্সের দোকানদার সেই নম্বর দিয়ে কথা বলছেন যাদের সঙ্গে, সেই গোয়েন্দারাই এখন তার সামনে হাজির। পুলিশ পাকড়াও করে দোকানদারকে। যিনি সিম কার্ড বিক্রি করেছেন, তাকে চিনিয়ে দেন সেই দোকানদার। পুলিশ মিরপুরের একটি মেসে গিয়ে খুনির সন্ান পান। কিন্তু একি! খুনি তো পরিচিত! যারা খুন হয়েছেন, তাদেরই আপন ভাগ্নে এই খুনি। মামার লাশ ধরে এই ভাগ্নেই সবচেয়ে বেশি কান্না করেছেন। লাশ উদ্ধার থেকে শুরু করে, ময়নাতদন্ত, জানাজা এবং দাফন পর্যন্ত ছায়ার মতো ছিল এই ভাগ্নে। পুলিশের কাছে ধরা ভাগ্নে তার মামা-মামিকে খুনের কথা স্বীকার করে।

রাজধানীর ৭৭ নম্বর নয়াপল্টনের বাসায় সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ এবং তার স্ত্রী রাহিমা খানমের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিন দিন পর খুনি নাজিমুজ্জামান ইয়ন গ্রেফতার হয় একটি সিম কার্ডের সূত্র ধরে। উন্মোচিত হয় সাংবাদিক দম্পতি ফরহাদ খাঁ হত্যার রহস্য। সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ ও স্ত্রী রাহিমা খানম চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায়ে ২ আসামি ভাগ্নে নাজিমুজ্জামান ইয়ন ও তার বন্ধু রাজু আহমেদ ওসানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করা হয়। ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার আদালতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। ২০১৬ সালের ১১ অক্টোবর দুপুরে এ রায় প্রদান করা হয়।

২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীতে ঘটে যাওয়া সাংবাদিক দম্পতি খুনের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয় সারা দেশে। তাও আবার খুনের শিকার হন প্রবীণ এক সাংবাদিক এবং তার স্ত্রী। নিজ শয়ন কক্ষে দুর্বৃৃত্তরা তাদের দুজনকেই জবাই করে হত্যার পর লুটে নিয়ে গেছে মালামাল। পুলিশ ও গোয়েন্দারা খুনিদের গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালালেও কোনো কূল কিনারাই তারা পাচ্ছিল না। এ নিয়ে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়। গ্রেফতার না হওয়ায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

খবরটি ছড়িয়ে পড়লে সাংবাদিক ও ফরহাদ খাঁর নাজিমুজ্জামান ইয়নসহ আত্মীয় স্বজনরা ভিড় করতে থাকে সেই বাসায়। মামার লাশ ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে ইয়ন। সেসময় কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি এই ইয়নই হচ্ছে এই জোড়া খুনের অন্যতম হোতা।

সামান্য টাকার লোভে আপন মামা ও মামিকে নির্মমভাবে খুন করে ভাগ্নে নাজিমুজ্জামান ইয়ন ও তার বন্ধু রাজু। ঘটনার রাতে অতিথি হয়ে তারা নিহত সাংবাদিক ফরহাদ খাঁর বাসায় রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। মামি তাদের রাতে খাবার খাইয়েছিলেন। ইয়ন পুলিশকে জানায়, ‘মেসে ও দোকানে ৭-৮ হাজার টাকা দেনা ছিল। এজন্য কিছু টাকার দরকার ছিল। মামি পিঠা খাওয়ার চাল নিয়ে বাসায় যেতে বললে এ সুযোগটি কাজে লাগাই। তারা ঘুমিয়ে গেলে আলমারির চাবি না পেয়ে তাদের খুনের সিদ্ধান্ত নিই। গভীর রাতে রাজু আর আমি মিলে মামা-মামিকে গলা কেটে হত্যা করি।’

এ ঘটনার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে নাজিমুজ্জামান জানায়, টাকার জন্যই  সে তার বন্ধু রাজুকে নিয়ে নিজ মামা-মামিকে খুন করে। পরে বাসা থেকে নগদ প্রায় ২০ হাজার টাকা, একটি  মোবাইল ফোন সেট ও কিছু স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। খুন করার পর ভোরে একটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে সে ও রাজু মিরপুরে চলে যায়। যাওয়ার পথে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত দুটি ছোরা পেপার মুড়িয়ে তার মামার বাসার পাশে একটি ড্রেনে ফেলে দেয়। অপর খুনি রাজুর ব্যাপারে ঘাতক নাজিমুজ্জামান জানায়, তার সঙ্গে রাজুর ৩ বছর ধরে পরিচয়। সে তার ভগ্নিপতির সঙ্গে একটি  কেমিক্যালের কারখানায় কাজ করে। খুনের বর্ণনা দিয়ে নাজিমুজ্জামান আরও জানায়, ঘটনার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সে ও রাজু নয়াপল্টনে মামার বাসায় যায়। এ সময় গেট বন্ধ থাকায় মামার মোবাইল ফোনে কল দিলে দরজা খুলে দেওয়া হয়। রাতে তারা খাওয়া-দাওয়া করে ড্রয়িং রুমে শুয়ে পড়ে। মামা-মামি ঘুমিয়ে গেলে দুজন মিলে বাসার আলমারির চাবি খুঁজতে থাকে। তা না পেয়ে দুজনকেই খুন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ডাইনিং রুমে পাওয়া দুটি ছুরি দিয়ে আগে মামি রাহিমা খানম ও পরে মামা ফরহাদ খাঁকে গলা কেটে খুন করা হয় বলে জানায় নাজিমুজ্জামান। তবে নিহত সাংবাদিক ফরহাদ খাঁর পরিবারের সদস্যরা ভাগ্নে নাজিমুজ্জামানের হত্যাকাণ্ডের এমন বর্ণনা যেন বিশ্বাসই করতে পারেননি অনেকেই। ফরহাদ খাঁর পরিবারের অপর সদস্যরা সেসময় জানান, তাদের ভাগ্নে যে টাকার জন্য আপন মামা-মামিকে খুন করতে পারে, এটা তাদের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে বেকার নাজিমুজ্জামান যে কিছুটা বখাটে হয়ে গিয়েছিল তা তারা জানতেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর