বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জঙ্গি আস্তানায় বিকৃত সাত লাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

জঙ্গি আস্তানায় বিকৃত সাত লাশ

রাজধানীর দারুস সালাম থানার বর্ধনবাড়ী এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরণের পর গতকাল তল্লাশিতে র্যাব সদস্যরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর দারুস সালাম থানার বর্ধনবাড়ী এলাকার জঙ্গি আস্তানা থেকে জঙ্গি আবদুল্লাহসহ সাতজনের বিকৃত লাশ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। নিহত অন্যদের মধ্যে আবদুল্লাহর দুই স্ত্রী ফাতেমা ও নাসরিন, দুই শিশু ওসামা (৩) ও ওমর (১০) এবং আবদুল্লাহর দুই সহযোগী রয়েছেন। মৃতদেহগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ঘটনাস্থল থেকে নিহতদের ডিএনএ, বিভিন্ন আলামত ও দুই ব্যারেল পেট্রল উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় সাতজনের পুড়ে যাওয়া ছিন্নভিন্ন মরদেহ প্যাকেটে ভরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে র‌্যাব।

গতকাল বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে জঙ্গি আস্তানায় তিনটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। ক্রমাগত বিস্ফোরণে ভবনে আগুন ধরে যায়। এতে প্রায় ৫০০ মিটার বেগে বিস্ফোরক পদার্থগুলো চারদিকে ছিটকে পড়ে। ভবনের পঞ্চম তলার জানালার থাইগ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পঞ্চম তলার মেঝেতে ফাটল ধরে। ওই ফাটল দিয়ে পঞ্চম তলার জঙ্গি আস্তানায় রাখা কেমিক্যাল চতুর্থ তলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের পর ওই কেমিক্যালে আগুন লেগে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া নিহতদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। আবদুল্লাহ ২০০৫ সালে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হন। ২০০৮-০৯ সালে জেএমবি ভেঙে তামিম-সারোয়ারের নেতৃত্বে নব্য জেএমবি গঠিত হলে তিনি নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। ওই গ্রুপে তিনি আল-আনসার সদস্য ছিলেন। তার বাসায় নব্য জেএমবির সারোয়ার, তামিম, সোহেল মাহফুজসহ শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই যাতায়াত করতেন।

র‌্যাবপ্রধান বলেন, ‘ভয়াবহ বিস্ফোরণে পঞ্চম ও চতুর্থ তলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাবধানতা অবলম্বন করে আমরা চতুর্থ তলা পর্যন্ত তল্লাশি শেষ করেছি। পঞ্চম তলায় তল্লাশি অভিযান চলছে। প্রচণ্ড গরমে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। গরম নিয়ন্ত্রণ করে তল্লাশি অভিযান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আমরা জানালার গ্লাসগুলো খুলে বা ভেঙে ফেলছি। ওই ভবন বসবাসের যোগ্য কিনা তা পরে জানা যাবে।’

আত্মঘাতী বিস্ফোরণে সবাই মারা গেছে কিনা— এমন প্রশ্নে র‌্যাবের ডিজি বলেন, ‘জঙ্গি আবদুল্লাহ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। এতে সবাই মারা গেছেন। গত বছর আটক এক জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল্লাহর নাম বেরিয়ে আসে। আমরা তাকে খুঁজছিলাম। ওই ভবনে তিনি জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, থাকা-খাওয়া ও ট্রেনিং দিতেন। আবদুল্লাহ আইপিএস, ইউপিএস, ফ্রিজ মেরামত করতেন। আবদুল্লাহ ওই বাড়ির ছাদে কবুতর পুষতেন। এলাকায় কবুতর আবদুল্লাহ নামেও তার পরিচিতি ছিল। বিস্ফোরণে অনেক কবুতর মারা গেছে। যেগুলো জীবিত আছে, সেগুলোর পরিচর্যা করা হচ্ছে। নিরপরাধ দুটো বাচ্চা ছিল, নারী ছিল, আমরা চেষ্টা করেছিলাম তাদের সেইফ করার জন্য। আবদুল্লাহ তো জঙ্গি ছিলেন। আর এই জঙ্গিদের খুনি মানসিকতার কাছে নিজ সন্তানরাও নিরাপদ নয়।’

র‌্যাব জানায়, জঙ্গি আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তার বাবা ইউসুফ আলী আগেই মারা গেছেন। আবদুল্লাহর বোন মেহেরুন্নেসা মেরিনাকে আটক করে র?্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ওই এলাকা পরিদর্শন করেন।

উল্লেখ্য, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বর্ধনবাড়ীর ২/৩-বি নম্বর ‘কমল প্রভা’ নামের বাড়িটি সোমবার রাত ১১টা থেকে ঘিরে রাখে? র?্যাব। বাড়ির পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। ওই বাড়ির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি থেকে ৬৫ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে জঙ্গি আবদুল্লাহ আত্মসমর্পণে রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেননি। রাত পৌনে ১০টার দিকে তিনি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান।

বাড়ির মালিক শৈলকুপার বাসিন্দা : ঢাকার মিরপুরের দারুস সালামে ছয়তলা যে ভবনটিতে জঙ্গি নেতা আবদুল্লাহসহ অন্য জঙ্গিরা ভাড়া থাকত, সেই ভবন মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ মুন্সির গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। জেলার শৈলকুপা উপজেলার ৫ নম্বর কাচেরকোল ইউনিয়নের বিত্তিদেবী রাজনগর গ্রামে রয়েছে তার বাড়ি। জানা গেছে, এই গ্রামে রয়েছে তার টিনশেড দুটি ঘর। বাড়ির সঙ্গেই রয়েছে একটি মাদ্রাসা। গত বছর ৬ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নূর-ই-জাহান নামের এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ। তার সম্পর্কে স্থানীয়রা আরও জানান, আজাদ ঢাকায় টিঅ্যান্ডটি অফিসে চাকরি করেন। ঈদসহ বছরে দু-একবার নিজের গাড়িতে চেপে বেড়াতে আসেন। স্ত্রীসহ সাব্বির ও স্নিগ্ধা নামে তার দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। প্রতিবেশী জাফর আলী, আন্না শেখসহ কয়েকজন জানান, হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ খুব কম সময়ের জন্য এলাকায় আসেন। তার ঢাকার বাসাতে জঙ্গির খবরে গ্রামবাসী বিস্মিত হয়েছেন। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার আবদুল কাদের জুলহাস জানান, গ্রামের বাড়িসহ এলাকায় ১৫ বিঘার বেশি সম্পত্তি রয়েছে হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদের। বাড়ি, সম্পত্তি এবং মাদ্রাসা দেখাশোনা করেন তিনি (জুলহাস)। বাড়িতে কেউ না থাকলেও ঈদের আগে তার মা নূরজাহান বেগমকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জুলহাসের ভাষ্য মতে, ঢাকায় তার মালিকের ভবনে আবদুল্লাহ নামে যে জঙ্গি নিহত হয়েছে সে দীর্ঘ কয়েক বছর বাসা ভাড়া নিয়ে রয়েছে। তারা তাকে সৌখিন কবুতর ব্যবসায়ী হিসেবে জানতেন।

শৈলকুপা থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, আমরাও বিভিন্নভাবে শুনতে পাচ্ছি ভবন মালিকের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপার বিত্তিদেবী রাজনগর গ্রামে। তবে এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো তথ্য থানায় আসেনি।

এদিকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় র‌্যাবের হাতে আটক দুই সহোদর মাসুম ও খোকনকে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল দুপুরে টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার পর পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালতের বিচারক রূপম কান্তি দাস চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে কালিহাতী থানায় তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব বাদী হয়ে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করে।

কোর্ট ইন্সপেক্টর আনোয়ারুল ইসলাম জানান, কালিহাতী থানা পুলিশ দুপুরে আটককৃত জেএমবির দুই সদস্য মাসুম ও খোকনকে আদালতে হাজির করে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।  এদিকে র‌্যাব-১২ এর কোম্পানি কমান্ডার বীণা রানী দাস জানান, মঙ্গলবার কালিহাতী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। উল্লেখ্য, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভাধীন মসিন্দা গ্রামের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুই জঙ্গিকে আটক করে র‌্যাব। সেখান থেকে একটি ড্রোন ও বেশ কয়েকটি চাপাটি, দুটি চাইনিজ কুড়াল ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আটককৃতরা হলো টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌর এলাকার মসিন্দা গ্রামের মরহুম আবুল হোসেন চিশতীর দুই ছেলে মাসুম (৩০) ও খোকন (২৫)।

সর্বশেষ খবর