মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে

ঠিক কতজন রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। সরকারি তথ্যে সাত লাখ ছাড়িয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক আসা তিন লাখসহ এই সংখ্যা দশ লাখের বেশি। বিপুল এ জনগোষ্ঠীর চাপ কীভাবে সামাল দেবে বাংলাদেশ? কী প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের ওপর। তিন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছেন মানিক মুনতাসির ও রুহুল আমিন রাসেল

অর্থনীতির ঝুঁকি অপরাধ বাড়বে

—মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে অর্থনীতির ঝুঁকি ও অপরাধ দুটোই বাড়াবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, রোহিঙ্গা সমস্যায় ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে চালের দাম বেড়েছে। এখন অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও বাড়তে পারে। কক্সবাজার ও পার্বত্যাঞ্চলে পর্যটন খাত ঝুঁকিতে পড়বে। চলমান রোহিঙ্গা সংকট পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে ফেলবেন রোহিঙ্গারা। শুধু চাপই নয়, এরা বাড়তি চাপ হিসেবে বোঝা হয়ে থাকবেন। স্বাস্থ্যসেবার ওপরও চাপ বাড়বে। আবার যে পরিবেশে তারা থাকবেন, সেখানে পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ও অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় ঝুঁকি বাড়বে।’ সরকারের সাবেক এই আমলা মনে করেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে থাকলে এবং পরে ফেরত পাঠাতে না পারলে সব দিক থেকেই বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়বে। আমাদের বার্ষিক বাজেট ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি বাড়বে। ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে বড় বিপদ ডেকে আনবে। ফলে কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায় পর্যটক কমে যাবে।’ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন প্রাজ্ঞ এই অর্থনীতিবিদ।

 

জাতীয় অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জে ফেলবে

—ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

অসংখ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় কক্সবাজারসহ ওই এলাকার পর্যটন, অর্থনীতি ও পরিবেশ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে গাছপালা ও পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ     করা হচ্ছে, শরণার্থীরা খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করায় ওই এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু রোহিঙ্গার খাদ্যের জোগান দিতে এবং সামাজিক ও মানবিক সহায়তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। যার বিরূপ প্রভাব শুধু কক্সবাজার এলাকায় নয় বরং দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তবে এসব শরণার্থী রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারলে সাময়িকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ফেরত পাঠাতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘায়িত হবে নেতিবাচক প্রভাব। কেননা রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে তারা জীবিকার তাগিদে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। এমনিতে কক্সবাজার এলাকায় আমাদের কাজের সুযোগ কম। এ ছাড়া পর্যটন এলাকা হিসেবে কক্সবাজার ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠলে পর্যটনের বৈশিষ্ট্য হারাবে কক্সবাজার। ফলে সেখান থেকে পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। যা আমাদের পর্যটন খাতে বিপর্যয় বয়ে আনবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতি। শুধু তাই নয় সেখানের পরিবেশ ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কক্সবাজার আমাদের পর্যটন এলাকা। রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ায় সেখানে নানাভাবে চাপ বাড়বে। ইতিমধ্যে গাছপালা ও পাহাড় কেটে বাড়ি ঘর নির্মাণ শুরু করা হয়েছে। এতে সে এলাকার পরিবেশের এবং প্রাণীকূলের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শরণার্থীরা এখানে থেকে গেলে তাদের কর্মসংস্থানের বিষয়টা সামনে চলে আসবে। এমনিতেই ওই এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। ফলে তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে পুরো এলাকার পরিবেশই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। বিপুল সংখ্যক এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে না পারলে তাদের পুনর্বাসন করা আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে তিনি মনে করেন। শুধু তাই নয় কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। কর্মসংস্থান না হলে জীবিকার তাগিদে এসব রোহিঙ্গা নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন। এতে কক্সবাজারসহ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এত চাপ নিতে প্রস্তুত নয়। ফলে সরকারকে খুব সতর্কতার সহিত এ ইস্যুকে মোকাবিলা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।

 

সাবধান থাকতে হবে ষড়যন্ত্র থেকে

মইনুল ইসলাম

ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলমান পরিস্থিতিকে মানবিক সংকট হিসেবে দেখা উচিত এবং বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ তাদের ভার বহন করতে পারবে বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তবে তিনি গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আরও বলেছেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। অপরাধ বাড়বে। এ সংকটের নেপথ্যে জড়িত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স— আইএসআই, তাদের সঙ্গী জঙ্গি জামায়াত-শিবিরের ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশকে সাবধান থাকতে হবে।’ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। তারা প্রাণভয়ে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সাধ্যমতো সহায়তার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ এই ৫ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করতে পারবে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে। রোহিঙ্গারা পরিবেশ নষ্ট করবে। নতুন করে পরিবেশগত সংকট বাড়বে। কারণ, রোহিঙ্গারা পাহাড় কেটে যে যেখানে পাড়েন বসবাস শুরু করবেন।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবেন। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাড়বে অপরাধ কর্মকাণ্ড। কারণ, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আরাকান আর্মি সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। বাংলাদেশে অতীতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জঙ্গি জামায়াত-শিবির পৃষ্ঠপোষকতা করে। আরাকান আর্মির সঙ্গেও জামায়াতের গোপন যোগাযোগ আছে। তাই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে পাকিস্তান ও জামায়াত-শিবিরের যে কোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে। এ ষড়যন্ত্র হতে বাংলাদেশকে সাবধান থাকতে হবে বলে মনে করেন দেশবরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ।

সর্বশেষ খবর