বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন

শরণার্থী শিবিরে আপ্লুত প্রধানমন্ত্রী, মিয়ানমারকে নির্যাতন বন্ধের আহ্বান

আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন

উখিয়ায় গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক রোহিঙ্গা শিশুর চোখের পানি মুছে দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তার বোন শেখ রেহানাও তখন শিশুদেরকে সান্ত্বনা দেন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগণের ওপর অমানবিক আচরণ এবং অন্যায়-অত্যাচার বন্ধ করে প্রতিবেশী মিয়ানমারের প্রতি শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। আমরা কোনো ধরনের অন্যায়-অত্যাচার গ্রহণ বা মেনে নিতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।’ গতকাল দুপুরে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমার থেকে আশ্রয়ের জন্য আসা জনগণের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণকালে এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী আধা ঘণ্টা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বার বার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং প্রত্যেকের কাছে তার সান্ত্বনার বাণী পৌঁছে দেন। তার বোন এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শরণার্থীদের হাতে নিজে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেন। এ সময় শরণার্থীরা তাদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীকে পেয়ে মিয়ানমারে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী দুর্গত নারী ও শিশুকে কাছে টেনে নেন। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এর আগে বিমানে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে প্রথমে কক্সবাজার এবং সেখান থেকে সড়কপথে উখিয়ায় পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রতি নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের শরণার্থীদের আশ্রয় দিলেও এ দেশের ভূমি ব্যবহার করে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাস্ত করা হবে না। আমরা মিয়ানমার সরকারের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে। তারা যেন প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যা যা সাহায্য করা দরকার, আমরা তা করব।’ রোহিঙ্গা নারীরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, তারা এক বস্ত্রে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। সঙ্গে করে কিছুই আনতে পারেননি। এ সময় নারী ও শিশুদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলে চোখ ভিজে ওঠে শেখ হাসিনার। তার সঙ্গে থাকা ছোট বোন শেখ রেহানাকেও চোখ মুছতে দেখা যায়। পরে সংক্ষিপ্ত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের ঘটনাকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমাদের মানুষদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মানুষ উপায় না পেয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। তাই আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে সাহায্য করছি। এ বিষয়ে আমরা কমিটিও করে দিয়েছি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য, আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আমি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে তাতে কি তাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? একজনের ভুলে এভাবে লাখ লাখ মানুষ ঘরহারা হচ্ছে। আমরা শান্তি চাই। আমরা ১৬ কোটি মানুষের দেশ। সবার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি। সেখানে আরও ২/৫/৭ লাখ মানুষকেও খেতে দিতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘এখন যারা যুবক তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। কিন্তু আমরা দেখেছি। তাই রোহিঙ্গাদের যেন কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’ বাকরুদ্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ঘটনা দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। মানুষ মানুষের মতো বাঁচবে। মানুষের কেন এত কষ্ট! নাফ নদে শত শত নারী-শিশুর লাশ ভাসছে, এটা মানবতাবিরোধী কাজ । আমরা আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। মানবতার খাতিরে এই দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। যত দিন মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরিয়ে না নেবে, তত দিন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করব।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। নিরাপত্তা দিতে হবে যেন ভালোমতো বাঁচতে পারে। তাদের সঙ্গে যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়।’

রাখাইন রাজ্যে বর্ডার পুলিশ, সীমান্তরক্ষীদের চৌকিতে হামলার ঘটনায় যারা দায়ী, তাদেরও কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার বন্ধ করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজ দেশের জনগণ অন্য দেশের শরণার্থী হিসেবে থাকা সম্মানজনক নয়। এ উপলব্ধি থেকে মিয়ানমার যেন তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়। বাংলাদেশ প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি চায়, সুসম্পর্ক চায়।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা ছাড়াও তার পুত্রবধূ আইওএম কর্মকর্তা পেপ্পি সিদ্দিক এ সময় কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, হুইপ ইকবালুর রহিম, সাইমুম সরওয়ার কমল, আবু রেজা মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন নদভী, আবদুর রহমান বদি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও উখিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। বিকাল ৪টার দিকে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার ত্যাগ করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর