বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দাপটে বিদেশি অপরাধীরা

আটকের পর জামিন পেয়ে ফের অপরাধে দ্রুত ফেরত পাঠানো ও জামিন বন্ধের সুপারিশ প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতিমালা

জুলকার নাইন

আইনি দুর্বলতার সুযোগে একের পর এক অপরাধ করেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাধ কাজে জড়িয়ে পড়া বিদেশিরা। ঢাকায় গত পাঁচ বছরে ২৬৩ বিদেশি অপরাধীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হলেও তারা জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপরাধে জড়াচ্ছেন। ফলে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না তাদের দৌরাত্ম্য। অথচ বিশ্বে কোথাও বিদেশি কোনো নাগরিকের একবার অপরাধ করে আটক হওয়ার পর শাস্তি ভোগ করে নিজ দেশে ফেরত যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বাংলাদেশে আদালত থেকে মুক্তির পর কীভাবে ফেরত পাঠানো হবে তার নীতিমালা নেই। পাশাপাশি ফেরত পাঠানোর খরচের অর্থ কোন উৎস থেকে আসবে সে বিষয়েও নেই কোনো নির্দেশনা। ফলত, আদালত কোনো বিদেশি অপরাধীকে মুক্তি দিলে সে আবার অপরাধে জড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভিনদেশি এই অপরাধীদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দরকার। প্রয়োজন বিমানবন্দরে আটকের পর কাউকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন ও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকার সুযোগে বিদেশি অপরাধীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত পাঁচ বছরে ঢাকার বিভিন্ন থানায় মোট ২৮৭ বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে ৯৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয় ২৬৩ বিদেশিকে। পলাতক থাকে ২৪। এর মধ্যে শুধু উত্তরায় গ্রেফতার হয় ১৯৩ জন। এ ছাড়া গুলশানে ৪০ জন, তেজগাঁও ১৪, মিরপুরে ৮, মতিঝিলে ৬ এবং রমনায় দুজন গ্রেফতার হয় পুলিশের হাতে। মামলায় গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার নাগরিক; সংখ্যা ৫৫। এ ছাড়া তাইওয়ানের ৩০, ক্যামেরুনের ২১, চীনের ১৯, পাকিস্তানের ১৬, গিনি বিসাউয়ের ৬, আইভরিকোস্টের ৫, ভারত ২, মিয়ানমার ১৫, গাম্বিয়া ৩, গুয়েতামালা ২, কঙ্গো ৪, মালি ২, পূর্ব আফ্রিকা ২, বেনিন ২, দক্ষিণ আফ্রিকা ২, মাল্টা ২, সেনেগাল ১, ফ্রান্স ১, মরক্কো ২, নেপাল ১, আলজেরিয়া ১, মোজাম্বিক ৩, ঘানা ১, জাম্বিয়া ১, টগো ১। গ্রেফতার ৬৩ বিদেশির নাগরিকত্ব শনাক্ত করা যায়নি। অপরাধী বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে জাল টাকা, চোরাকারবার, চোরাচালান, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, মাদক ব্যবসা, বৈধ কাগজপত্রবিহীন অবস্থান, চুরি, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, জঙ্গিবাদ, হ্যাকিং, হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এসব মামলা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এগুলো শুধু মামলার হিসাব । বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। জানা যায়, বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রথমে বৈধভাবে এদেশে ঢোকে। পরে তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হলে তারা অবৈধভাবেই বাস করছে। সাধারণত বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, পর্যটক, ব্যবসায়ী বা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। অবৈধ এবং অপরাধে জড়িত এই বিদেশিদের বেশিরভাগই ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, বিমানবন্দর, ভাটারা, গুলশান, শেরেবাংলা নগর ও বনশ্রী এলাকায় বাস করছে। তারা সবচেয়ে বেশি জাল টাকা, তৈরি ও বিপণন এবং ও চোরাকারবারে জড়িত। এদের কারণে দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রচুর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিকভাবে লিভটুগেদারও বেড়েছে এসব অবৈধ বিদেশির কারণে। ছড়াচ্ছে এইডস ও অন্যান্য রোগব্যাধি। আশঙ্কা বেড়েছে জঙ্গিবাদের। সর্বোপরি বিঘ্ন ঘটছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার। পুলিশের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশিদের (বৈধ-অবৈধ) দ্বারা সংঘটিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোনো বিদেশিকে যখন কোনো অপরাধে গ্রেফতার করা হয়, দেখা যায় যে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, তার কোনো বৈধ ভিসা এমনকি পাসপোর্টও নেই। সেক্ষেত্রে তাদের সঠিক জাতীয়তা নির্ণয় করাও সম্ভবপর হয় না। অবৈধ বিদেশি এবং অপরাধে অভিযুক্ত (বৈধ/অবৈধ) বিদেশিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশ কোর্টের মাধ্যমে জেলে পাঠাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, তাদের জামিন হয়ে যায় এবং তারা মুক্তি পায়। জামিনে মুক্তি পেয়ে তারা আবার অপরাধে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

কেন এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এরা এক ধরনের দুষ্টচক্রের মাধ্যমে কাজ করে। অনেকক্ষেত্রে পাসপোর্ট/ভিসা না পাওয়ায় সঠিক নাম ঠিকানা, দেশ বা জাতীয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। বেশিরভাগক্ষেত্রেই অপরাধীরা মিথ্যা নাম-ঠিকানা-জাতীয়তা দিচ্ছে। পরে জামিনে বেরিয়ে এসে নতুন করে ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করছে তারা। অনেক ক্ষেত্রেই আফ্রিকার এসব দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে না থাকায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও পাওয়া যায় না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিদেশি অপরাধীদের ফৌজদারি বিচার, জামিন, জেল, সাজা শেষে ফেরত পাঠানো-আলাদা হেফাজতে রাখার ক্ষেত্রে সঠিক ও কার্যকর নীতিমালার অভাব। অবৈধ বিদেশিদের দৌরাত্ম্য বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো এক সুপারিশপত্রে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশিদের সম্পর্কে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে ব্লক রেইড করে এদের সবাইকে গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে অপরাধী বিদেশিদের প্রবেশ ঠেকাতে দেশের স্থল ও বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সঠিক সমন্বয় সাধন করতে হবে যেন ভিসার মেয়াদ শেষ হলে বা হালনাগাদ না করলে তাত্ক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানানো হয়। পাশাপাশি বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবৈধ বিদেশিরা কোনোক্রমেই যাতে জামিন নিয়ে এদেশে আবার বাস করতে না পারে, গ্রেফতার হওয়া বিদেশিদের বিচার চলাকালীন বা সাজা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি এসব বিষয়ে একটি কার্যকর নীতিমালা চায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর