বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

হোয়াইট হাউসের তীব্র প্রতিক্রিয়া

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

হোয়াইট হাউসের তীব্র প্রতিক্রিয়া

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় হোয়াইট হাউস। পাশাপাশি রাখাইনে সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদে সরব হয়েছে উন্নত বিশ্ব। জাগ্রত হয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার বিবেক। ক্ষুব্ধ জাতিসংঘ, রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের অনন্য ভূমিকায় প্রকাশ্যে প্রশংসা করছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ফ্রান্স। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল আসছে চলতি সপ্তাহেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার যুক্তরাজ্য গতকাল সুইডেনকে সঙ্গে নিয়ে জাতিসংঘে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের প্রস্তাব করেছে। কঠোর অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারে সব সাহায্য প্রকল্প স্থগিত করেছে জার্মানি। মিয়ানমারের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনায় রয়েছে কানাডা। সবাই বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করছে এবং বাড়িয়েছে সহায়তার হাত। তবে চীনের পররাষ্ট্র দফতর থেকে গতকাল মিয়ানমার সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এখনো প্রকাশ্য অবস্থান জানায়নি রাশিয়া। প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে গিয়ে একবারের জন্যও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করলেও পরে ঢাকার দাবির মুখে মিয়ানমারকে সতর্ক হতে বলেছে নয়াদিল্লি। পালিয়ে আসা মানুষদের মানবিক সহায়তার জন্য গতকাল ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, মিয়ানমার নিজ দেশের বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সংকট উত্তরণে মিয়ানমারকে কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যান্ডার্স রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘২৫ আগস্ট পুলিশ চেকপোস্টে হামলার পর অন্তত ৩ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। আমরা ওই হামলা ও সহিংসতার নিন্দা জানাই। মিয়ানমারের রাখাইনের এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র।’ সেখানকার বেশিরভাগ বাস্তুহারা মানুষই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ায় আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ জানাই। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে সারা স্যান্ডার্স বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, হত্যা ও ধর্ষণসহ অনেক অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আইনের প্রতি সম্মান রেখে এই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে রাখাইন কমিশনের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করারও আহ্বান জানাই আমরা।’

সাহায্য প্রকল্প স্থগিত জার্মানির : বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে, রাখাইনে নৃশংস সহিংসতার কারণে মিয়ানমারে বেশ কিছু সাহায্যমূলক প্রকল্প স্থগিত করেছে জার্মানি। স্থগিত করা প্রকল্পগুলোতে জার্মানি অর্থ সহায়তা দিত খাদ্য নিরাপত্তা, কর্ম সংস্থান সৃষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবামূলক খাতে। জার্মানির উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ক্যাথারিনা মেঞ্জ বলেছেন, রাখাইনের যেসব এলাকায় সহিংসতা চলছে সেখানে আমাদের প্রকল্পগুলো বা কর্মসূচিগুলো স্থগিত থাকবে। সহিংসতা বন্ধ হলেই তা আবার চালু হবে। জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফেন সেইবার্ট বলেছেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার পরিস্থিতির দিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে জার্মানি। সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে তিনি সংঘাতে লিপ্ত সব পক্ষ, বিশেষ করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা ফ্রান্সের : গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সোফি অ্যাবর্ট। এ সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার জন্য ফ্রান্সের প্রতি আহ্বান জানান। জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, রাখাইনে মিয়ানমারের চালানো গণহত্যা এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের অনন্য ভূমিকা সম্পর্কে ফ্রান্স পুরোপুরি অবহিত। এ বিষয়ে ফ্রান্স বাংলাদেশের পাশে আছে। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।

জাতিসংঘে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আহ্বান : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলমান পরিস্থিতির সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকার অনুরোধ করেছে সুইডেন ও ব্রিটেন। কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, আজ বুধবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতে পারে। এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচআরসি) প্রধান জায়েদ রাদ আল হুসেইন মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিকে জাতিগত নিধনের আদর্শ উদাহরণ আখ্যা দেন। এর আগে গত ৩০ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদের একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর চলতি মাসের শুরুর দিকে নিরাপত্তা পরিষদকে উদ্দেশ করে এক বিরল চিঠি লেখেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতারেস। চিঠিতে তিনি রাখাইনের সহিংস পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ত্রাণ হিসেবে ২৫ কোটি টাকা ঘোষণা ডেনমার্কের : বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ডেনমার্ক সরকার। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মাধ্যমে এই ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে। ত্রাণ সহায়তা ঘোষণার পাশাপাশি ডেনমার্কের উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী উল্লা টোর্নাইস রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত নিয়ে তার গভীর উদ্বেগ ও রোহিঙ্গা নিধন অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

৯৫ টন ত্রাণ পাঠাতে চায় ইরান : ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য ৯৫ টন ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ত্রাণ ও উদ্ধার সংস্থার প্রধান মোর্তেজা সালামি জানিয়েছেন, একটি কার্গো বিমান করে এসব ত্রাণ নেওয়া হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুমতির প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরপরই তা পাঠানো হবে। মোর্তেজা সালামি জানান, প্রাথমিকভাবে এসব ত্রাণ-সামগ্রী মিয়ানমারে পাঠানোর কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে পরে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারকে সমর্থন চীনের : অব্যাহত রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে চীন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানাচ্ছে চীন। তবে সেখানে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখতে মিয়ানমার সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও একে সমর্থন জানানো উচিত।

ভারতের রোহিঙ্গা উচ্ছেদের হুমকির সমালোচনায় জাতিসংঘ : ভারত থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে বিতাড়িত করার হুমকির নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। রাখাইনে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলাকালে তাদের ভারত থেকে বের করে দেওয়া হলে তা প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ-আল হুসেইন।

 টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনে নয়াদিল্লির সমালোচনা করা হয়।

উভয় দিকে ভারসাম্য দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের : মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে ভারত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাখাইন পরিস্থিতিকে মিয়ানমারের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই আখ্যা দিয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। তবে গত রবিবার নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে সরাসরি রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রসঙ্গ না তুললেও বেসামরিক হত্যাকাণ্ড এড়ানোর প্রতি মিয়ানমারকে নজর দিতে বলা হয়। তাগিদ দেওয়া হয়, শান্তিপূর্ণ পথে সংকট মোকাবিলার। বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিয়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরের  বিবৃতি দেয় বলে উল্লেখ করে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। গতকাল টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক। উভয় দেশই বিমসটেকের সদস্য। রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফেরা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে বোঝানো উচিত ভারতের।’

সর্বশেষ খবর