বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১৩

খুনির তথ্যে বিভ্রান্ত পুলিশ

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনির তথ্যে বিভ্রান্ত পুলিশ

২০০০ সালের মধ্য জুলাইয়ে রাজধানীর এক সকাল শুরু হয়েছিল অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতোই। শুধু স্বাভাবিক ছিল না রামপুরার ডিআইটি রোডের ৩ নম্বর বাড়িতে। এ বাড়ির সকালটা যেখানে শুরু হতো হৈচৈয়ের মধ্য দিয়ে, সেই বাড়ি সেদিন নীরব নিস্তব্ধ। বাড়ির সদা হাস্যোজ্জ্বল অষ্টাদশী মেয়ে বুশরার চোখ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার হলো নিজের বেডরুম থেকে। শোকের চেয়ে বাড়িতে ছিল আতঙ্ক। পুলিশ এলো। জানা গেল, ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বুশরার জন্য তার বাবা-মা যতটুকু না পাগলপ্রায়, তার চেয়ে তার মামার শোক যেন ছিল একটু বেশি। খুনিদের গ্রেফতারে তিনি পুলিশকে ধমক-টমকও দিচ্ছিলেন। তার অতি উৎসাহে পুলিশের সন্দেহ হয়। সন্দেহ থেকে তার ওপর নজরদারি। জমিজমার বিষয়টি যখন সামনে  চলে আসে, পুলিশ নিশ্চিত হয়, খুনি আর কেউ নয়, বুশরার মামাই তার খুনি। গ্রেফতার হয় মামা আবদুল কাদের। খুনি চক্র প্রভাবশালী হওয়ায় তদন্ত থেমে থেমে চলেছে। সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্রী রুশদানিয়া বুশরা ইসলাম খুনের ঘটনা এটি। ১৭ বছর আগে তার বয়স ছিল ১৮ বছর। ২০০০ সালের জুলাই মাসে হাসিখুশি এই তরুণীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার হয়েছিল নিজের বেডরুম থেকে। রাতভর তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলেও বাসার কেউ কিছু তখন জানতে বা বুঝতেও পারেননি। ঘটনার পর খুনিদের গ্রেফতারে যিনি তৎপরতা দেখিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি, বুশরার সেই মামা এম এ কাদের খুনের ঘটনায় পরে গ্রেফতার হন। বাড়িসহ জমি আত্মসাৎ করতেই এই খুনের ঘটনাটি ঘটে বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে। তবে তৎকালীন সময়ে তিনি সরকার সমর্থিত আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় পুলিশের তদন্ত চলেছে ধীরগতিতে। ওই সময়ে বুশরা খুনের ঘটনাটি আলোচিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বুশরার খুনি সরকারি দলের নেতা হওয়ায় ঘটনাটি গুরুত্ব পায় বেশি। পত্রপত্রিকায় বুশরা খুনের ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হওয়ায় পুলিশ বাধ্য হয়েছিল কাদেরকে গ্রেফতার করতে। পরে বুশরা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল কাদেরের। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন বুশরা। বাবা সিরাজুল ইসলাম ছিলেন সহকারী পুলিশ সুপার। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন অবসরকালীন ছুটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; মা লায়লা ইসলাম ছিলেন গৃহিণী। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা তাদের গ্রামের বাড়ি। বুশরা ডিআইটির ওই বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন। মা থাকতেন গ্রামের বাড়ি। ঘটনার কয়েক মাস আগে তারা ঢাকায় চলে আসেন। জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে অন্যদের জাগাতেন বুশরা। ওই বাসায় তার মা বাদেও থাকতেন তার এক খালা, পরিবারসহ মামা এম এ কাদের। কাদেরের এক শ্যালিকাও থাকতেন ওই বাড়িতে। সেদিন বুশরা কাউকে ঘুম থেকে জাগাননি। কাজের বুয়া সুফিয়া সকাল ৮টায় বুশরাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ডাকাডাকি করতে থাকেন। কিন্তু কোনো সাড়া নেই বুশরার। সুফিয়া সেখান থেকে গিয়ে বুশরার মাকে ডেকে আনেন। বুশরার মা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পান, খাটের ওপর এলোমেলোভাবে শুইয়ে আছেন বুশরা। তার কাপড়-চোপড় খাটের নিচে পড়ে রয়েছে। এ দৃশ্য দেখে অজানা আশঙ্কায় মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। তিনি ওই ঘরের পেছন দিকের জানালার কাছে গিয়ে দেখতে পান, গ্রিল গোল করে কাটা। জানালা দিয়ে তিনি ভিতরে বুশরাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। চোখ ছিল কালো কাপড়ে বাঁধা। খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ দরজা ভেঙে বুশরার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ নিশ্চিত হয়, বুশরাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। পরে জানালার গ্রিল কেটে তারা পালিয়ে যায়। যারাই এ খুনের ঘটনায় জড়িত থাকুক, তারা যে বুশরাদের পরিচিত ছিল, এ বিষয়ে পুলিশের আর কোনো সন্দেহ ছিল না। আগে থেকেই ওই বাড়িতে খুনিরা অবস্থান করছিল। রাতের যে কোনো এক সময়ে বুশরার রুমে গিয়ে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ সময় বুশরার মামা তৎকালীন ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের ত্রাণ সম্পাদক এম এ কাদের ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি তার ভাগ্নি বুশরার খুনিদের ড়্রেফতারের জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেন। তিনি পুলিশকে খুনিদের গ্রেফতারে নানা পরামর্শ দিতে শুরু করেন। তৎকালীন শাসক দলের মহানগরী নেতা হওয়ার কারণে পুলিশও তাকে সমীহ করতে থাকে। কিন্তু বাড়ি ও জমি আত্মসাতের বিষয়টি যখন সামনে চলে আসে, তখন পুলিশ নিশ্চিত হয়, কাদের নিজেই এ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনার আগের রাতে তিন যুবক কাদেরের ঘরে অবস্থান করছিল বলে কাজের বুয়া পুলিশকে জানিয়েছেন। পুলিশের তদন্তে জানা যায়, ৩ নম্বর ডিআইটির ওই বাড়ির মালিক বুশরার আরেক মামা। তারা সপরিবারে আমেরিকা থাকতেন। বুশরা একটি কক্ষে থেকে লেখাপড়া করতেন। বুশরার মা যখন গ্রাম থেকে এই বাড়িতে একেবারে চলে আসেন, কাদেরের ধারণা ছিল বাড়ির মালিকানা তারা পাবেন। বুশরাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই বুশরার বাবা-মাও এই বাড়িতে থাকবেন না। এমন চিন্তা থেকেই বুশরাকে তার ভাড়াটিয়া লোকজন দিয়ে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটান বলে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে।

সর্বশেষ খবর