বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১৪

খুনির পিছু নিয়ে গোয়েন্দারা গেল ভিনদেশের হোটেলে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনির পিছু নিয়ে গোয়েন্দারা গেল ভিনদেশের হোটেলে

রাজধানীতে একজন ব্যবসায়ী খুনের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড়। শাসক দলের একজন এমপিপুত্র এই খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকায় সরকারও বিব্রত। কিন্তু পুলিশ খুনিদের মধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করতে পারলেও এমপিপুত্র তার অপর সহযোগীদের নিয়ে লাপাত্তা। এ নিয়ে পুলিশ প্রশাসন বেশ চাপের মধ্যে পড়ে। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ নেটওয়ার্ক প্রয়োগ করে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনোভাবেই কিছু হচ্ছে না। গোয়েন্দারা খবর পেল, খুনের আসামিরা যশোর বেনাপোল সীমান্ত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। তারা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি হোটেলে অবস্থান করছে। সেখানে তারা বেশ ভালোভাবেই দিন কাটাচ্ছে। ঢাকায় খুনের ঘটনাটি এতটাই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে যে, পুলিশ কলকাতার হোটেলে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। সেমতে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেফতারে কলকাতা গেল। সেই হোটেলে অভিযানও চালাল। কিন্তু গোয়েন্দারা হতাশ। তাদের অভিযানের সংবাদ আগেই পৌঁছে গেছে খুনিদের কাছে। তারা আবারও লাপাত্তা। তবে ভিনদেশের সেই হোটেলের একটি কক্ষে মিলল ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে। পুলিশ ইমনকে কলকাতা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ঢাকায় ফিরে আসল। ১৭ বছর আগে রাজধানীর বনানী কুয়েত মৈত্রী মার্কেটে তরুণ ব্যবসায়ী ইফতেখার আহমেদ শিপুকে গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা। শিপু খুনের আসামিদের গ্রেফতারে কলকাতার হোটেলে এভাবেই গোয়েন্দাদের একটি অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। তবে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন সেখানে গ্রেফতার হওয়ায় পুলিশের মধ্যে আত্মতৃপ্তিও ছিল তখন বেশ।

ডেটলাইন ২৪ মে, ২০০০ সাল : সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অভিজাত এলাকা বনানীর কুয়েত  মৈত্রী মার্কেট। মানুষের বেশ ভিড়। পার্কিংয়ে গাড়ি ঢুকছে, বেরোচ্ছে। হঠাৎ ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকারে মার্কেট প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে তখন দৌড়ে নেমে আসছিল অস্ত্রধারী কয়েক যুবক। মাকের্টের সাহসী তরুণ ব্যবসায়ী ইফতেখার আহমেদ শিপু তাদের একজনকে জাপটে ধরে ফেললেন। যুবকরা তাদের সহযোগীকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যবসায়ীর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালাল। ব্যবসায়ীর বুকপিঠ বুলেটে হলো এফোঁড় ওফোঁড়।

খুনের এই ঘটনাটি আলোচিত হয়ে ওঠে তখনই, যখন ফাঁস হয় হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন শাসক দলের এক প্রভাবশালী এমপির ছেলে জুয়েল। শিপুকে হত্যা করেই ফাঁকা গুলি করতে করতে তারা গাড়িতে চড়ে লাপাত্তা বনে যায়। অভিযোগ রয়েছে, খুনের পর জুয়েল ও তার বন্ধুরা গুলশান থানা পুলিশের পাহারায় ওই এলাকা ত্যাগ করেন। তখন ঘটনাটি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। বিশেষ করে এমপির ছেলের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর এটি হয়ে ওঠে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। খুনের প্রতিবাদে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সংগঠন বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে। ধর্মঘট, হরতাল সবই হয়েছে এই খুনের প্রতিবাদে। চাঞ্চল্যকর শিপু হত্যা মামলার বিচারে আদালত জুয়েলসহ ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু এদের প্রত্যেকেই এখন মুক্ত। এ পর্যন্ত দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছিল। জুয়েলসহ চারজন কখনো এ মামলায় গ্রেফতার হননি। মামলার নথিপত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রভাবশালী এমপির ছেলে জুয়েল ও তার সহযোগীরা বনানীর কুয়েত মৈত্রী মার্কেটের তৃতীয়তলায় মোবাইল ডটকম নামে একটি দোকানে যান। দোকান থেকে দামি মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নিয়ে তারা দোকান থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় দোকানের মালিক ব্যবসায়ী ইফতেখার আহমেদ শিপু মার্কেটের নিচে রজনীগন্ধা নামের একটি দোকানে বসাছিলেন। তিনতলায় তার দোকান থেকে কর্মচারীর চিৎকার- চেঁচামেচি শুনে শিপু রজনীগন্ধা দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় জুয়েলসহ ছয়জন সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নিচে নামছিলেন। শিপু তখন জুয়েলকে জাপটে ধরে ফেলেন। জুয়েলের সহযোগীরা জুয়েলকে ছাড়িয়ে নিতে ধস্তাধস্তি শুরু করেন। এক পর্যায়ে জুয়েলের সহযোগী জোবায়ের শিপুর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে পর পর দুই রাউন্ড গুলি চালায়। গুলি শিপুর বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই শিপুর মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় শিপুর ভাই ইশতিয়াক আহমেদ বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু জুয়েল ও তার সহযোগীদের পুলিশ আটক করেনি। পরে তারা প্রথমে ভারত এবং সেখান থেকে কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। শিপু হত্যাকাণ্ডের সময় তার একমাত্র কন্যা জায়না চার বছরের ছিল আর শিশুপুত্র জারিফের বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। পুত্র হত্যার খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় আক্ষেপ ছিল শিপুর বাবা-মায়ের। ছেলের নৃশংস খুনের ঘটনায় বিচার দেখে যেতে পারেননি তারা। ২০০৪ সালে শিপুর বাবা মকবুল আহমেদ ও ২০১০ সালে মা রাবেয়া খাতুন মারা যান। শিপুর পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রকাশ্যে শিপুকে হত্যা করার ঘটনায় আদালতে রায় দিল আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কোনো আসামিও ধরা পড়েনি। আলোচিত শিপু হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি কামাল মজুমদারের ছেলে হওয়ায় পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেফতার করেনি বলে হতাশ তারা। মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রেজাউল করিম। যিনি বর্তমানে সহকারী কমিশনার। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, তাদের কাছে খবর ছিল কলকাতার একটি হোটেলে শিপু হত্যার আসামিরা আত্মগোপন করে আছেন। সেই তথ্য মতে, কলকাতা গিয়ে তারা ওই হোটেলে অভিযান চালান সেখানকার পুলিশের সহযোগিতায়। কিন্তু তাদের পাওয়া যায়নি। সেখানে পাওয়া গিয়েছিল দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে। ইমনকে গ্রেফতারের পর কলকাতা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি বলেন, এই মামলায় ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরা হলেন জুয়েল, সাগর, সৈকত, জয়, জোবায়ের এবং শফিউল। জয়কে রক্তমাখা কাপড়সহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। সাগরকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর