বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

১২ নোবেল বিজয়ী ও ১৫ বিশ্ব নেতার খোলা চিঠি

নিজস্ব প্রতিবেদক

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে সংস্থাটির কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন ১২ নোবেল বিজয়ীসহ ২৭ জন বিশ্বনেতা।

গতকাল ইউনূস সেন্টারের পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে এই খোলা চিঠির কপি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

চিঠিতে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তার অবসানে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে মিয়ানমার থেকে শরণার্থী প্রবাহ বন্ধ এবং তাদের ফিরিয়ে নেওয়া, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, জাতিসংঘের ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন ও পীড়িত এলাকা   পরিদর্শনসহ সাত দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারী নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন : ২০০৬ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ১৯৭৬ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মেইরিড ম্যাগুয়ার, ১৯৭৬ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বেটি উইলিয়ামস, ১৯৮৪ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটু, ১৯৮৭ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অস্কার অ্যারিয়া সানচেজ, ১৯৯৭ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জডি উইলিয়ামস, ২০০৩ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদি, ২০১১ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী লেইমাহ বোয়ি, ২০১১ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তাওক্কাল কারমান, ২০১৪ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই, ১৯৯৩ পদার্থবিজ্ঞান বা মেডিসিনে নোবেল বিজয়ী স্যার রিচার্ড জে রবার্টস এবং ২০০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞান বা  মেডিসিনে নোবেল বিজয়ী এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন।  

স্বাক্ষরকারী বিশ্বনেতাদের মধ্যে রয়েছেন : সাবেক মালয়েশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সৈয়দ হামিদ আলবার, সাবেক ইতালিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমমা বোনেনি, ব্যবসায়ী নেতা ও দার্শনিক ডা. স্যার রিচার্ড ব্রান্সন, নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রো হার্লেম ব্রুডল্যান্ড, দার্শনিক ও উদ্যোক্তা মো. ইব্রাহীম, মানবাধিকার কর্মী কেরি কেনেডি, লিবিয়ান নারী ভয়েস এসডিজি অ্যাডভোকেট আলা মুরবিত, ব্যবসায়ী নেতা নারায়ান মূর্তি, থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসিট পিরোমাইয়া, আসিয়ানের প্রাক্তন মহাসচিব ডা. সুরিন পিটসুয়ান, বিজনেস লিডার এসডিজি অ্যাডভোকেট পল পোলম্যান, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের স্থায়ী উন্নয়ন সনদ নেটওয়ার্কের পরিচালক জেফরি ডি. স্যাস, অভিনেতা ফরেস্ট হুইটেকার এবং ব্যবসায়ী নেতা ও দার্শনিক জোচেন জাইজ। খোলা চিঠিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকট পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবীয় ট্র্যাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, তার অবসানে আপনাদের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণে শত শত রোহিঙ্গা জনগণ নিহত হচ্ছে জানিয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বহু গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে এবং শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আতংকের বিষয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে এই এলাকায় প্রায় একেবারেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যার ফলে দারিদ্র্যপীড়িত এই এলাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।  স্থানীয় সরকার সূত্রগুলোর মতে, গত দুই সপ্তাহে তিন লাখেরও বেশি মানুষ তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মৃত্যুর মুখে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে।  এর আগে পূর্ববর্তী বছরেও সেখানে সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল সে বছরের শেষে আমরা কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিক এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আপনাদের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য সব হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, যার ফলে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে এবং রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, মিয়ানমার সরকার যে যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে তা একেবারেই আজগুবি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর এবং পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়কালে বার্মা তার সীমানাভুক্ত রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক বলে স্বীকার করে নেয় এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও দেয়। এটা আশ্চর্যজনক যে, ১৯৮০-র দশকে সে দেশের সামরিক শাসকরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে বসে যে,  রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়। এরপর তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদের সে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। শুরু হয় জাতিগত ও ধর্মীয় নিধনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সুপরিকল্পিত নির্যাতন। জাতিসংঘ মহাসচিব যথার্থই বলেছেন যে, ‘রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অমীমাংসিত দুর্দশা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার একটি অনস্বীকার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকদের অবশ্যই সহিংসতার এই দুষ্টচক্র বন্ধ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং নিপীড়িত সবার নিরাপত্তা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ২০১৬ সালে যে ‘রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশন’ গঠন করেছিল তার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে আপনারা যেন জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন—সেজন্য আমরা আবারও আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। কফি আনানের সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিশন—যার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক—রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, অবাধ চলাচলের সুযোগ, আইনের চোখে সমান অধিকার, রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, যার অভাবে স্থানীয় মুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নিজ ভূমিতে ফিরে আসা মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছিল। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের আক্রমণ এই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণিত করল। স্থায়ী শান্তির জন্য গঠনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ১. কমিশনের সদস্যগণ অবিলম্বে সুপারিশ বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধানের জন্য একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের জন্য পুনর্বিবেচনা করুন। ২. উদ্বাস্তুদের বহিঃপ্রকাশ বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। ৩. নিয়মিত ভিত্তিতে দুর্বল এলাকায় পরিদর্শন করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানান। ৪. ইতিমধ্যে শরণার্থী যারা দেশ ছেড়েছেন তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

৫. ইউএন ফিনান্সিং এবং তত্ত্বাবধানে তাদের পুনর্বাসন সুবিধা প্রদানের জন্য ফেরত উদ্বাস্তুদের জন্য মিয়ানমারের মধ্যে ক্যাম্প স্থাপন।

৬. তাদের বাস্তবায়ন কমিটির একচেটিয়া কর্তৃপক্ষের অধীনে কমিশন রিপোর্টে নির্ধারিত নাগরিকত্ব দিন এবং

৭. রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আন্দোলনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করুন।

সর্বশেষ খবর