বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্ম চিন্তা

উত্ফুল্লতার কাছে ফিরে এসেছি

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

উত্ফুল্লতার কাছে ফিরে এসেছি

এ নিয়ে বই লেখা হয়েছে। বিশেষ করে আমেরিকায়, যেখানে সবারই উত্ফুল্ল থাকার কথা। বিষাদ সবার মনকে করে রেখেছে আচ্ছন্ন। একটু পর মেঘ কেটে যায় অবশ্যই, যেমন ফ্লোরিডার আকাশ, যেখানে মেঘ জমবেই, আবার আলোও ফুটবে। ওদের জীবনে কেন এত বিষাদ? এত পাওয়ার পরও কেন হতাশা? কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করলাম, যারা আমার বয়সী। বললেন, জীবনের প্রান্তে এসে মনে হচ্ছে বৃথাই চলে গেল সুন্দর জীবনটি। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। থাকে অন্য শহরে। নাতি-নাতনিরাও বিচ্ছিন্ন। এখন আছি ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে কিছু ভালো মেন্যু সিলেক্ট করে সেগুলোর দিকে মনোনিবেশ। আর আপনাদের মতো লেখক-গায়ক পেলে তাদের কাছ থেকে কিছু শুনি। বললাম, বয় স্কাউট ছিলেন কোনো দিন? বয় স্কাউটদের বক্তব্য : ‘প্রস্তুত থাকবে সব সময় জীবনের চালিকাশক্তি হতে পারে। দুশ্চিন্তা কখনো কোনো দিনকে উজ্জ্বল করেনি, কোনো সমস্যার সমাধান করেনি, সুস্থতা আনেনি কোনো অসুস্থের জীবনে। আল্লাহ বসে টিকিটটি নিয়ে, যে টিকিট চায় তার কাছে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে দেন। আশি ছুঁই ছুঁই জীবনে প্রতিদিন এমনটি ঘটেছে। স্ত্রীকে বললাম, ফ্লোরিডায় যাব বড় মেয়েকে দেখতে। সঙ্গে সঙ্গে এমন ব্যবস্থা হলো যে বলার নয়। মুহূর্তে টিকিট হাজির। ব্যবস্থা প্রস্তুত, প্লেনে চড়ার অপেক্ষা। কী করে তাই বলছি। আগামীকালের সমস্যার কথা আজ আলোচনা করবেন না, তাতে আজকের সামর্থ্য কমে যায়। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে, আজ নয়। কাল আগে এসে উপস্থিত হোক। আগামীকাল আপনার সামর্থ্য কী হবে তা তো আপনি জানেন না। তাহলে আজকে আপনার যতটুকু সামর্থ্য আছে, তাকে নিয়েই হোক যাত্রা। ইংরেজিতে ঠিক এইভাবে লেখা যেতে পারে : Miracle at the higher grounds/Your promised land is here.

যা জানতাম না। ফুলের কাছে যাওয়া অপ্রয়োজনীয়। গোলাপ এসে সুগন্ধি ছড়িয়ে যাবে? হ্যাঁ। আগে জানতাম না। আমার মনকে নিয়ে গেলাম গোলাপবাগানে। চারদিকে নানা রঙের গোলাপ। এদের কি গন্ধ নেই? শুধুই গোলাপের বাহ্যিক রূপ, গন্ধহীন, সুরভিহীন। গভীর নিঃশ্বাস নিলাম। আমার চারদিকে নবীনারা পড়াশোনা করছে, আমার দিকে তাকাচ্ছে, এ কোন দেশের মানুষ, বসে থেমে থেমে লিখছে কোন ভাষায়, তাদের মনের কথা? আমার কলমের কালি ফুরিয়েছে, তাতে কী, অন্য ভাষায় কথা বলে আমায় একটি কলম দিল। তাকে বললাম : Bless Me. সঙ্গে সঙ্গে আমি লম্বা শ্বাস নিলাম। গোলাপের গন্ধ পেলাম। হয়তো আমার মনের ভুল। আবার দীর্ঘশ্বাস। আবার গোলাপের গন্ধ। ওটি তাহলে আমার মনের মধ্যেই ছিল। এরই নাম : MINDFULNESS. মনের মধ্যেই যে লুকিয়ে তাকে খুঁজে বের করব। মনের মধ্যেও কোথাও লুকিয়ে : শান্তি ও স্তব্ধতা। স্তব্ধ কর অন্তরকে। পারবে? একদম শান্ত, ‘স্তব্ধ অতল দিঘিকালো নিশীথ শীতল মায়া’ পারবে? আমি পারলাম। এক মিনিটেই আমি স্তব্ধতার অন্তরাল। এদের পদ্মফুলের মধ্যে আমি এসে। চারদিকে সকালবেলার টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ছে পদ্মপত্রে। একি, তবে ঝরে পড়ছে আমার ওপরই। আমিই পদ্মপত্র। একেকটি ঢেউ এসে ঝরছে আমার পায়ের কাছে। এরা আমার চিন্তার ঢেউয়ের মতো। তারা মিলিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা। আমি নিজে যে যোগব্যায়াম করি, যা লেখা এই সংখ্যার NEWSWEEK-এ লিখেছেন ক্রিস্টান ম্যাকগি। তিনি আমার মনের কথা কী করে জানলেন। তার বইয়ের নাম Chair Yoga. অর্থাৎ চেয়ারে বসেই পাবে যুগ যুগ ধরে সন্ন্যাসীরা যা ভেবেছে তার অনুস্মৃতি। অনুস্মৃতিই আগের জন্মের স্মৃতি ম্যাকগি কী শেখাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের? মনঃসংযোগ। মনকে বাঁচিয়ে রাখা। অন্যমনস্ক নয়, মনস্ক থাক প্রতি মুহূর্তে, প্রতি নিঃশ্বাসে। Be present and Mindful. মনকে ঘুরে বেড়াতে দিও না। নামাজে মন সবচেয়ে বেশি ঘুরে বেড়ায়। ওখান থেকে সিজদার জায়গায় মনকে একটু স্থিত কর। প্রতিটি কথার প্রতিটি শব্দের ওপর মনকে বসাও। এটাই শিক্ষার, আর কিছু নয়। নিউজউইক ৫ ডলারের। আমার এ কথাগুলো ১০০০ ডলারের| Be Here. Be Mindful. Be alive in the Moment. এ লেখাকে বড় করা যায়, সত্যি বলতে কি বই কেনার লোক পাওয়া গেলে বই লিখে ফেলা যায়। বই বিক্রি হবে মাত্র পাঁচ কপি, বইয়ের ক্রেতা পাওয়া দুষ্কর। তার চেয়ে আজকের এই লেখাতেই মনের মধ্যে মনকে কীভাবে প্রবেশ করা যায়, তার সংকেতটি দিই। এক. সব রকমের দুশ্চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলুন। ওরা যেন আর কাছাকাছি আসতে না পারে। দুই. এই মুহূর্তটিকেই উপভোগ করুন। এই মুহূর্ত আর নাও আসতে পারে। তিন. সত্যিকার আনন্দ কী, খুঁজে বের করুন। নিজে নিজে উত্ফুল্ল হোন। আপনি সবচেয়ে ভালো সময়ে অবস্থান করছেন। চার. একটু থামুন। বোকারাটন শহরের সবচেয়ে মজার জায়গা বইয়ের দোকান। নাম : ‘বার্নস অ্যান্ড নোবেলস’। আমার ঠিকানা। শ্রেষ্ঠ লেখকরা এখানে বসে আছেন স্টারবাক্স কফি হাতে। চিহ্নিত হতে চান না। বই পড়ে চলেছেন একটার পর একটা, কফি হাউসের স্টলে বসে, আমি তাকিয়ে ওদের দিকে। সেরা লেখক হতে হলে কী করতে হয়? মিলিয়ন বই কীভাবে বিক্রি হয়? ওরা বসে বসে অন্যের বই পড়েন, আর ভাবতে থাকেন নতুন কিছু। উত্ফুল্লতা প্রস্তুত হয় মনে। মনটি আবিষ্কার করুন। মুহূর্তে পৃথিবী অন্যরকম। সবকিছু নিজের আয়ত্তে। ঢাকায় ফিরে এসে প্রথম দিন গেলাম গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদে ইশার নামাজে। আমাকে দেখে অবাক। যাদের সঙ্গে রমজান মাসে প্রতিদিন নামাজ পড়েছি, আমাকে এক মাস না দেখে ধরে নিয়েছেন, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছি। হ্যাঁ, বিদায় নিয়েছিলাম বইকি সবকিছু থেকে, বইয়ের মধ্যে ডুবে। উত্ফুল্লতার প্রধান কারণ। বই পড়ুন ও উত্ফুল্ল হোন। নিজের পৃথিবী নিজে গড়ে তুলুন।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব [email protected]

সর্বশেষ খবর