শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১৬

চিরকুটেই ছিল রুবেল খুনের রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

চিরকুটেই ছিল রুবেল খুনের রহস্য

মেঝের ওপর পড়ে আছে যুবকটি। খালি গা। ফোলা ফোলা লাল দাগ। পরনে জিন্সের প্যান্ট। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। চোখ বন্ধ। প্রলাপ বকছে। চারপাশে ঘিরে আছে লাঠিসোঁটা হাতে সাত-আট জন সাদা পোশাকের পুলিশ। কারও হাতে শটগান। মিনিট পাঁচেক আগে এরা সবাই মিলে যুবকটির ওপর চড়াও হয়েছিল। এখন হাঁপিয়ে উঠেছে। সে কারণে বিরতি। ১০ মিনিট বিশ্রাম শেষে তারা যুবকটিকে টেনে নিয়ে গেল ঘরের বাইরে। পানিভর্তি বড় হাউস। যুবকটিকে হাউসের পাশে নিয়ে বসানোর চেষ্টা। শরীরের শক্তিতে আর কুলোচ্ছে না। বসতেও পারছে না। কয়েকজন তাকে ধরে বসিয়ে রাখল। একটি গামছা এনে তার মাথার ওপর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। আর একজন মাথার ওপর পানি ঢালতে লাগল। ভেজা গামছা তার নাক-মুখে লেপ্টে থাকায় শ্বাস বার বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু ওরা থামছে না। ভয়ঙ্কর পানি থেরাপির খেলায় তখন তারা মত্ত। মাথার ওপর পানি ঢালছে, আর নিচে গড়িয়ে পড়ছে রক্তলাল পানি। কিছু সময় এভাবে চলার পর হঠাৎ সাড়াশব্দ বন্ধ। নড়াচড়া নেই। নেই শ্বাস-প্রশ্বাসও। বন্ধ হয় যুবকটির দেহঘড়ি। এটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দফতরে ১৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক নির্মম ঘটনার চিত্র। নানা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারান ২৩ বছরের যুবক শামীম রেজা রুবেল। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র তরতাজা যুবক রুবেলকে বাসার সামনে থেকে পেটাতে পেটাতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর মাত্র ৫ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত রুবেলকে সইতে হয়েছিল নানা কায়দার নিষ্ঠুর নির্যাতন। ডিবি অফিসে এই নির্যাতনের আগে রুবেলকে মারধর করা হয় মৌচাকের বাসার সামনেই। বাঁচাও, বাঁচাও আর্তচিৎকার শুনে রুবেলের বৃদ্ধ মা, ভাবী রাস্তায় ছুটে আসেন। মা, ভাবী পুলিশের পা জাপটে ধরেন। পুলিশের ওই সদস্যরা হেঁচকা ধাক্কায় ফেলে দেন তাদের। গোয়েন্দা পুলিশ খুনের ঘটনাটি ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, কারও কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে পুলিশ এ কাজটি করেছে। পুলিশ তখন মেধাবী ছাত্র রুবেলকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে প্রচার করতে থাকে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের নানাভাবে জেরা করে প্রকৃত ঘটনা বের করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বক্তব্যে থাকেন অনড়। একপর্যায়ে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা অভিযুক্তদের একটি চিরকুট দেখান। তাতে হাতে লেখায় রুবেলের নাম ও ঠিকানা ছিল। সেখানে আরও এক মহিলার নামও ছিল। যিনি রুবেলের নাম-ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন। এই চিরকুট দেখেই অভিযুক্তদের মধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসআই হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরের বুক কেঁপে ওঠে। কারণ তার কাছেই এক মহিলা রুবেলের নাম-ঠিকানা দিয়েছিলেন। সেই কর্মকর্তা আর অস্বীকার করতে পারেননি। হত্যার দায় কবুল করতে বাধ্য হন। তার নেতৃত্বেই সেদিন তুলে আনা হয়েছিল রুবেলকে। আর এই টিম ছিল তৎকালীন আলোচিত এসি আকরামের। ইতিমধ্যে এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। ডিবির তৎকালীন এসআই হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে ডিবির তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আকরাম হোসেনকে খালাসের দেওয়া রায় বহাল রাখে আদালত। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির বেঞ্চ চলতি বছরের ২৮ মার্চ দুটি আপিল খারিজ করে দিয়ে এ রায় দেয়।

যা ঘটেছিল : ৩৬ মিন্টো রোড। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দফতর। হাজতখানার বাইরে চার-পাঁচ জন পুলিশ মিলে বেধড়ক পেটাচ্ছেন এক যুবককে। কেউ লাঠি দিয়ে, কেউ শটগান দিয়ে। কেউ আবার লাথি, কিল-ঘুষি। যে যেভাবে পারছেন, মারতে মারতে পুলিশ সদস্যরাই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। যুবকটির গগনবিদারী চিৎকারে ডিবি অফিসে তখন এক ভীতিকর পরিস্থিতি। হাজতখানায় আটক দাগি আসামিরাও পুলিশের এমন উন্মত্ত আচরণে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ কাঁদছিলেনও। হতভাগ্য ওই যুবকটিকে একপর্যায়ে মেঝের ওপর ফেলে পুলিশের দুই সদস্য হাত ও পা চেপে ধরেন। অন্য একজন যুবকটির বুকের ওপর উঠে লাফাচ্ছিলেন। জবান বন্ধ হওয়ার অবস্থা যুবকটির। শুধু গোঙানির শব্দ। ওই অবস্থায় তাকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হয় ডিবি অফিসের মূল ভবনের পেছনের পানির হাউসের সামনে। সেখানেই প্রাণ হারান হতভাগ্য যুবকটি।

১৯৯৮ সালে ‘রুবেল হত্যা’র এ ঘটনাটি দেশজুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনার পরদিন পত্রপত্রিকায় ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর স্তম্ভিত গোটা দেশ। ক্ষুব্ধ মানুষ নেমে আসে রাজপথে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। এসি আকরামসহ তার টিমের প্রত্যেকের বিচার দাবি করতে থাকে। এ দাবিতে সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়।

দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে যিনি হয়েছিলেন সারা দেশের মানুষের চোখের মণি, রুবেল হত্যার পর সেই এসি আকরাম তখন খলনায়ক। অনেকেই অভিযোগ করেন, তার প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসে এই হত্যার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন ডিবির ভালো চেহারার পেছনে যে এক ভয়ঙ্কর রূপ ছিল, মারা গিয়ে তা জানান দিয়ে গেছেন হতভাগ্য রুবেল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ওই সময়ে ডিবি পুলিশের নানা অপকীর্তি ফাঁস হতে থাকে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে আলোচিত হওয়া এসি আকরাম ও তার টিমের সদস্যরা কীভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জোর করে টাকা আদায় করছেন, সেসব ঘটনাা এই সময়ে ফাঁস হয়। দেশের মানুষের কাছে নায়ক হয়ে ওঠা এসি আকরাম মুহূর্তেই খলনায়কে পরিণত হন। ভুক্তভোগী অনেকেই এ সময় অভিযোগ করে বলেছেন, এসি আকরামের সঙ্গে দেখা করতে হলেই মোটা অঙ্কের ভিজিট দিতে হতো। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের নাম ভাঙিয়ে এসি আকরামসহ তার দলের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে ওঠার নানা ঘটনাও ফাঁস হয়। ডিবি পুলিশ সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে ওঠে মূর্তিমান আতঙ্ক। এ হত্যাকাণ্ডটি ডিবি পুলিশের অতীতের সব অর্জন ধূলিসাৎ করে দেয়; যা পুনরুদ্ধারে বহু বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে পুলিশের এই সংস্থাকে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল রাজধানীর সার্কুলার রোড এলাকার বাসার সামনে থেকে ধরে নিয়ে রুবেলকে অমানুষিক নির্যাতন করে। ধরে নেওয়ার পর অস্ত্র উদ্ধারের নামে রুবেলকে তার বাসার কাছে নিয়েও প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। রুবেলের পরিবারের সদস্যরা এ সময় রাস্তায় পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে রুবেলের প্রাণ ভিক্ষা চান। পুলিশের মন গলেনি তাতেও। তারা রুবেলকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় আবারও গোয়েন্দা দফতরে। অমানুষিক নির্যাতন করা হয় রুবেলকে। নির্যাতনে রুবেলের মৃত্যু হলে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেন ডিবির কয়েক কর্মকর্তা। ওই সময় ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আকরামের নির্দেশে রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। নির্যাতন চালান ডিবির উপ-পরিদর্শক হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরসহ কয়েকজন। ওই হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে মামলা হয় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন এসি আকরামসহ ১৩ ডিবি পুলিশ। ওই হত্যা মামলায় নয়জন গ্রেফতার হন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় পুলিশেরই অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। তদন্তে বেরিয়ে আসে রুবেলের প্রতিবেশী রোকসানা বেগম ওরফে মুকুলী বেগমের ইন্ধনেই রুবেলকে আটক করে নির্যাতন করা হয়।

ময়নাতদন্তে যা আসে : ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও প্রমাণিত হয়, রুবেলকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘রুবেলের কপালের বাঁ পাশে চোখের ওপর অনুমান দেড় ইঞ্চি লম্বা কালো দাগ, ডান হাতের বাহুর ওপর কালো দাগ এবং বগলের নিচে একই রকম দাগ। বাঁ পায়ের তালুতেও কালো দাগ দেখা গেছে। দুই হাতের আঙ্গুলগুলো ফোলা, বাঁ পায়ের পেছনে কালো দাগ, পিঠের ডান পাশে কালো দাগ। তার নাক দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল।’

চাঞ্চল্যকর ওই হত্যা মামলায় ২০০২ সালের ১৭ জুন বিচারিক আদালত আকরামসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন এবং মুকুলী বেগম নামের এক আসামিকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। বিচারিক আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই হাই কোর্টে আপিল করে আসামিপক্ষ। ২০১১ সালের ৫ মে হাই কোর্ট আকরাম, মুকুলী বেগমসহ ১৩ আসামিকে খালাস দেয় এবং হায়াতুল ইসলামের সাজা বহাল রাখে। খালাস পাওয়া অন্যরা হলেন পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম, এসআই আমীর আহমেদ তারেক, নুরুল আলম, এএসআই আবদুল করিম, হাবিলদার নুরুজ্জামান, কনস্টেবল রাতুল পারভেজ, মীর ফারুক, মং শে ওয়েন, আবুল কালাম আজাদ, কামরুল হাসান, জাকির হোসেন। হাই কোর্টের রায়ের পর ২০১১ সালের ৯ মে রাতে কারাগার থেকে মুক্তি পান আকরাম।

সর্বশেষ খবর