রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ২৭ চেকপোস্ট

রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে বাংলাদেশি সিম

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

মিয়ানমার সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশি অপারেটরদের সিম ব্যবহার করছেন। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই তারা কিনতে পারছেন এ দেশের অপারেটরদের সিম। মূলত যোগাযোগের তাগিদ থেকেই তারা এসব সিম কিনছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের হাতে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি সিম তুলে দিচ্ছে স্থানীয় একটি নেটওয়ার্ক সিন্ডিকেট। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব সিম বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর নিবন্ধন না থাকায় এসব সিম ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য দালালদের দারস্থ হয়। দালালরাই তাদের বন, জঙ্গল, পাহাড় ও নদী পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে ব্যবহূত সিম ও মোবাইলের ব্যবস্থাও তারা টাকার বিনিময়ে করে দেয়। তাই কখনো কখনো বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই এ দেশের সিম পায় রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের বলিবাজার এলাকার মৌলভী শফিক (২৫) নামে যুবক এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে আসেন। কুতুপালং টিভি রিলে কেন্দ্রের পূর্বপাশে নতুন ঝুপড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। তাকে মোবাইলে কথা বলতে দেখা গেল। এ সময় তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মোবাইল ও সিম কেনার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারেই আমার মোবাইল ছিল। বাংলাদেশে আসার পর একজনের কাছ থেকে ১৫০ টাকায় একটি সিম (রবি) কিনেছি।’ কার কাছ থেকে সিম কিনছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে শফিক বিক্রেতার নাম বলতে পারেননি। তবে তিনি জানান, মূলত দালালরা গোপনে সিম ও মোবাইল প্যাকেজ আকারে বিক্রি করছে। রোহিঙ্গারাও এর সুযোগ নিচ্ছে।

শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গারা হাতে, পকেটে, গলায় ঝুলিয়ে রাখছে মোবাইল। নারীরাও মোবাইল ব্যবহার করছেন। তারা গায়ে পরিহিত পোশাকের ভিতর মোবাইল গুঁজে রাখছেন। প্রয়োজন হলে বের করেই কথা বলছেন। তারা মোবাইল অপারেট করতেও পারদর্শী।

শুক্রবার দুপুরে ত্রাণের জন্য বসে থাকা নারীদের মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায়। এ সময় পরিচয় জানতে চাইলে এক নারী জানান, তার নাম জামালিকা। মোবাইল কোথায় পেয়েছেন—জানতে চাইলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেন। পরে আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘আই ন জানি।’ পরে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

তবে মোবাইল ও সিম সংগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করে জিয়াবুল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ফকিরা বাজার এলাকায় আমাদের বাড়ি। বাবা-মা ও ভাইবোনসহ মোট নয়জন বাংলাদেশে এসেছি। একটি মোবাইল ও সিম দেড় হাজার টাকায় কিনেছি। কুতুপালংয়ে বাজারের একটি দোকান থেকে সিমটি ২০০ টাকায় কিনেছি।’ সিম কিনতে কাগজপত্র বা ছবি দিতে হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কোনো কাগজপত্র লাগেনি।’ এ সময় মিয়ানমারের মজিব নামে একজন বলেন, ‘নাফ নদ পার হয়ে শাহপরীতে প্রথমে এক দিন ছিলাম। সেখানে এক ব্যক্তির কাছ থেকে সিমটি (রবি) কিনে নিয়েছি। সিম কেনার সময় বিক্রেতা কোনো কাগজপত্র চাননি।’ কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনের সড়কেই অনেকগুলো মোবাইল সার্ভিসিং ও রিচার্জের দোকান দেখা গেল, যেখান থেকে রোহিঙ্গারা সিম কিনছে। এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, উখিয়ার মরিচ্যা বাজারের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হেফাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালীর আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক দিনে ৫০ হাজার সিম বিক্রি করেছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে। এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘এগুলো নজরদারির জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া না দেওয়ার অনুরোধ : মিয়ানমার থেকে বিতারিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া না দেওয়ার জন্য সাধারণ জনগণকে অনুরোধ করেছে পুলিশ সদর দফতর। একই সঙ্গে যাতায়াতের জন্য রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের পরিবহনে না উঠাতেও অনুরোধ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়া এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে অবহিত হয়ে পুর্িলশ সদর গণমাধ্যমের মাধ্যমে এসব অনুরোধ জানায়। গতকাল গণমাধ্যমগুলোতে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে। তারা নিজ দেশে না ফেরা পর্যন্ত নির্দিষ্ট ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। রোহিঙ্গাদের অবস্থান এবং গতিবিধি শুধু কক্সবাজারের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে সীমাবদ্ধ থাকবে। তারা ক্যাম্পের বাইরে তাদের আত্মীয়স্বজন অথবা পরিচিত ব্যক্তিদের বাড়িতে অবস্থান কিংবা আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবেন না। তাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পের বাইরে কেউ বাসা-বাড়ি ভাড়া দিতে পারবেন না। রোহিঙ্গারা নির্দিষ্ট ক্যাম্পের বাইরে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে অথবা যাতায়াত করতে পারবেন না। তারা সড়ক-রেল-নৌ পথে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতে পারবেন না। সব ধরনের পরিবহনের চালক-শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রোহিঙ্গাদের পরিবহন না করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেউ আশ্রয় কিংবা বাড়ি ভাড়া দেওয়া অথবা তাদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়ার অথবা অবস্থানের খবর জানলে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইজিপির নির্দেশে এই পরামর্শ গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।

২৭ ‘চেকপোস্ট’ : মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২৭টি চেকপোস্ট বসিয়েছে। দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের এই নাগরিকদের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ার কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় গতকাল চট্টগ্রাম নগরে এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনির-উজ-জামান। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে নগরের খুলশী এলাকায় ডিআইজির কার্যালয়ে পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও পুলিশ সুপারদের নিয়ে এ মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। মনির-উজ-জামান বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা যাতে কোনো অবস্থাতেই মূল ভূ-খণ্ডে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে বিষয়ে পুলিশসহ প্রশাসন সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। তাদের কক্সবাজারে সীমিত রাখার কাজ চলছে। ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামে পুলিশের মোট ২৭টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।’ নতুন আসা রোহিঙ্গাদের রাখতে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র করেছে সরকার। অন্য কোথাও রোহিঙ্গাদের পেলে তাদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ডে রোহিঙ্গাদের আটক করে কক্সবাজারে ফেরত পাঠায় পুলিশ। দুর্গাপূজায় নিরাপত্তার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের চাপ উৎসবের আনন্দ ম্লান করতে পারবে না বলেও মতবিনিময়ে জানানো হয়। মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি কুসুম দেওয়ান এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার ছাড়াও ১১ জেলার পূজা উদ্?যাপন পরিষদের নেতারা অংশ নেন।

সর্বশেষ খবর