মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান

হিউম্যান রাইটসের বিবৃতি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান

মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর কঠোর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এজন্য নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। তবে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে দ্রুত মিয়ানমারের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও আহ্বান জানিয়েছে তারা। গতকাল এক বিবৃতিতে এসব আহ্বানের পাশাপাশি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নিধন’ রুখতে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমারের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। এইচআরডব্লিউর এশিয়া অ্যাডভোকেসি পরিচালক সিফটন বলেন, ‘মিয়ানমারে সামরিক কর্মকর্তারা যদি অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে পড়ে তবেই তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে সাড়া দেবে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারকে ঔপনিবেশিক ‘বার্মা’ হিসেবে পরিচিত করেছে। এতে বলা হয়েছে : রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ সহিংস ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হচ্ছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এবার দেশটির  সেনাবাহিনীর ওপর এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা দরকার  যেন কোনোভাবেই সেদেশের জেনারেলরা তা উপেক্ষা করতে না পারে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং এই ইস্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের ওপর কঠোর অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেন তাদের জাতিগত নিধনসংক্রান্ত প্রচারণা ও কার্যক্রম বন্ধ করা যায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, প্রথমত নিরাপত্তা পরিষদের একটি উন্মুক্ত আলোচনায় বসা উচিত। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকেও আমন্ত্রণ জানানো উচিত আলোচনায়। যারা এরকম নৃশংস অপরাধ করেছে তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে শাস্তির বিষয় নিশ্চিত করা উচিত পরিষদের। এইচআরডব্লিউ মনে করছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়। মিয়ানমারে তাদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত এবং অপরাধী নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। সামরিক সহায়তা বন্ধ করা, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং মিয়ানমারের সেনা পরিচালিত ব্যবসাগুলোর আর্থিক লেনদেনও বন্ধ করা উচিত। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াংকে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশালি ডেজিগনেটেড ন্যাশনালস (এসডিএন) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত মার্কিন সরকারের। এই তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে পারেন না, মার্কিন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারেন না এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদও বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর সদস্য দেশগুলোরও এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত।

সারা বিশ্বের ফার্স্ট লেডিদের এমিনি এরদোগানের চিঠি : মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে সারা বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের স্ত্রী ও ফার্স্ট লেডিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোগান। গত শনিবার তিনি এ চিঠি লিখেছেন বলে গত দুই দিনে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে যাওয়া এমিনি এরদোগান চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমরা যারা বিশ্বনেতাদের স্ত্রী বা ফার্স্ট লেডি, তারা সত্যিই অনেক মানবিক হতে পারি। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা অসহায় রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্যে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করবে। চিঠিতে এমিনি আরও বলেন, ‘একজন মা, একজন নারী ও একজন মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, এমন এক মানবিক পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সবাই মিলেমিশে থাকবে। যেখানে থাকবে না কোনো জাতিগত কিংবা ধর্মীয় বৈষম্য। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের কথা স্মরণ করে এরদোগানের স্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সীমান্তে গিয়ে আমি রোহিঙ্গা নারীদের গল্প শুনেছি। ওই নারীরা বলেছেন, তাদের চোখের সামনে স্বামী-সন্তানকে মিয়ানমার সেনারা হত্যা করেছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওই সব করুণ কাহিনী আমাকে আঘাত করেছে, নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে। সু চির কানাডার নাগরিকত্ব বাতিলের দাবি : রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ায় কানাডায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাতিলের দাবি উঠেছে। দেশটির রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ছাড়াও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিকরা বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছে এ দাবি তুলে ধরছেন। এ ছাড়া ইন্টারনেটে এ বিষয়ে একটি পিটিশন ক্যাম্পেইন চলছে, যেখানে পাঁচ দিনে প্রায় নয় হাজার মানুষ সই করেছেন। অবশ্য শনিবার টরেন্টোতে কয়েকটি সংগঠন আয়োজিত এমন এক সমাবেশে অংশ নেন খোদ কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। রাখাইনে চলমান সেনা অভিযান সম্পর্কে ফ্রিল্যান্ড বলেন, মিয়ানমার সরকারের অভিযান মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে। কানাডার সরকার এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য প্রার্থনা সভা করে বিপাকে ভারতীয় নেত্রী : মিয়ানমারে নিহত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রার্থনা সভার আয়োজন করে বিপাকে পড়েছেন ভারতের আসাম তথা উত্তর-পূর্বে বিজেপির তিন তালাকবিরোধী লড়াইয়ের নেত্রী বেনজির আরফান। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইউনাইটেড মাইনরিটি পিপলস ফোরামের উদ্যোগে মিয়ানমারে খুন হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য গত শনিবার ফ্যান্সি বাজারে প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন তিনি। এটিকে ‘অপরাধ’ উল্লেখ করে আসাম প্রদেশ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বেনজিরকে সাসপেন্ড করে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন। নোটিসে বলা হয়, দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে, দলের নীতি-আদর্শের তোয়াক্কা না করে, মিয়ানমারের ঘটনা নিয়ে অন্য সংগঠনের হয়ে কর্মসূচির কথা এভাবে পোস্ট করে নিয়ম ভেঙেছেন বেনজির।

পালানোর পথ খুঁজছে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা : মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দুর্গম এলাকায় দুটি রোহিঙ্গা গ্রামে আটকে পড়া কয়েক হাজার মানুষ নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ চেয়ে আবেদন জানিয়েছে। আহ নাউক পিন গ্রামের বাসিন্দা মং মং টেলিফোনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, তাদের খাবার ফুরিয়ে এসেছে। আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আমাদের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। ওরা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

 ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেছেন, রাখাইনের বৌদ্ধরা তাদের গ্রামে এসে হুমকি দিয়ে বলে গেছে-‘পালা, নইলে সবাইকে মারব’।

গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে পুলিশ পোস্ট ও সেনাক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর থেকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এই ভয়ঙ্কর অভিযান চলছে। মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বিদ্বেষ পেয়েছে নতুনমাত্রা। চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

সর্বশেষ খবর