মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গুরুত্ব দেন না মন্ত্রী এমপিদের

দলবাজি আর গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছেন তারা, উন্নয়ন কাজে গতি নেই, ভোটের আগে আতঙ্ক নেতাদের

নিজামুল হক বিপুল ও রফিকুল ইসলাম রনি

উন্নয়ন কাজ ও প্রশাসনে সর্বাত্মক মনঃসংযোগ বাদ দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় এখন সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। দলীয় নেতাদের ছাপিয়ে তারাই এখন সিদ্ধান্ত নেন দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। কাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে, কাকে সরাতে হবে, কাকে পদ দিতে হবে এমন সিদ্ধান্তও দিয়ে থাকেন মাঠ প্রশাসনে কর্মরত একাধিক জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএন) এবং পুলিশ সুপার। তারা এখন মাঠ পর্যায়ে সরকারি দলের স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং দলীয় নেতাদের কথা, নির্দেশনা খুব একটা গ্রাহ্য করেন না বলে অভিযোগ উঠেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভিতর থেকেই। কয়েকটি ঘটনায় তার সত্যতাও পাওয়া গেছে। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় ডিসি, এসপি, ইউএনওরা এখন নেতাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সরকারি দলের একজন নেতা বলেন, ২০০১ সালে দেখেছি ভোটের আগে হঠাৎ বদলে গেছেন অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা। অনেকে কেনাবেচা হয়ে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যিনি যত বেশি অতিউৎসাহী ছিলেন তিনি তত দ্রুত বদলে গিয়েছিলেন। এদিকে নোয়াখালীর একটি ঘটনা বিস্মিত করেছে অনেককে। জানা গেছে, নোয়াখালী জেলা পরিষদের স্থগিত ২ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে নির্বাচন আদালতের জাল সার্টিফাইড কপির ভিত্তিতে স্থগিতের নির্দেশ দেন নোয়াখালীর ডিসি। গত ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলা পরিষদের স্থগিত ২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে হাই কোর্টের জাল সার্টিফাইড কপি পেশ করলে ওই নির্বাচন আবারও স্থগিত করে দেওয়া হয়। জাল সার্টিফাইড কপিতে দুই প্রার্থীর মধ্যে একজন একেএম ইমরুল চৌধুরীর প্রার্থিতা বাতিলের কথা উল্লেখ থাকায় রিটার্নিং অফিসার নির্বাচন স্থগিত করেন। কিন্তু কারণ অনুসন্ধানে নেমে ইমরুল চৌধুরী জানতে পারেন যে ওই সার্টিফাইড কপিটি জাল। প্রতিপক্ষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য এই অসাধু কৌশল অবলম্বন করে আর ওতে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা ডিসিও সায় দেন। এ ব্যাপারে ডিসির সঙ্গে কথা বলার সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি উপলব্ধি করেন যে, ডিসি অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত। সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি দলের একজন সিনিয়র নেতাকে বলেন, এক বছর পর ভোট। এখন দলের ভিতরে ডিসি ও এসপিরা সমস্যা তৈরি করলে আমরা কীভাবে কাজ করব!

শুধু নোয়াখালী নয়, সারা দেশেই একই চিত্র। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটের সময় পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের ভূমিকায় স্থানীয় মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হন। আবার অনেক জেলা প্রশাসক উন্নয়ন কাজ ব্যাহত করছেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করে। একটি বড় জেলার ডিসির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ মন্ত্রী, এমপিদের। প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইলও তারা আটকে রাখেন। এতে সার্বিক উন্নয়নের গতি কমে যাচ্ছে। অনেক জেলা প্রশাসক নিজেকে সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, সরকারি দলের সদস্যরা কাজের সময় দেখা যায় ঘাটে ঘাটে যন্ত্রণা তৈরি করছেন। যার ফলে সমস্যা তৈরি হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হয়। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। দক্ষিণের অধীনে একটি থানার কমিটিতে এক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা তার এক নিকট আত্মীয়ের নামভুক্তির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকে সুপারিশ করেছেন। যার নামভুক্তির সুপারিশ তিনি করেছেন, নগর রাজনীতিতে তিনি কখনই সক্রিয় ছিলেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

দক্ষিণের কমিটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন নেতা আক্ষেপ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অতীতে কারা মাঠে ছিল, কারা ছিল না সেটা আমাদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না। কিন্তু কমিটি গঠনের সময় এখন নামভুক্তির সুপারিশ করেন সরকারি কর্মকর্তারা। শুধু কমিটি গঠনই নয়, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্মকর্তা এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শ দেন কীভাবে দল চালাতে হবে। আবার মাঠ প্রশাসনের কিছুকিছু কর্মকর্তা প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও নেতার নিকটাত্মীয় হওয়ার শক্তিতে শক্তিমান; তাই তারা স্থানীয় নেতাদের বা কখনো কখনো এমপিদের যৌক্তিক কাজও করে দেন না।  

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, কিছু প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীর জামাই, ভাই, শ্যালক ও বউয়ের স্বজনেরা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রশাসনের শীর্ষ পদে বসা। এরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করেন। এদের পছন্দমতো বা সুবিধাজনক না হলে এরা এমপি ও নেতাদের নির্দোষ সুপারিশও রক্ষা করেন না।

মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আছকির খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে উদ্বুদ্ধ হন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরীফুল ইসলাম। অভিযোগ আছে, ইউএনওর ইচ্ছামতো উপজেলা চেয়ারম্যান অনেক কাজ না করায় তিনি চেয়ারম্যানের ওপর বিরক্ত হন। সুযোগ খুঁজতে থাকেন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তিনি উপজেলার আটটি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে ঐক্যবদ্ধ করে উপজেলা চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করতে অনাস্থা প্রস্তাব ওঠানোর উদ্যোগ নেন। বিষয়টি জানার পর মৌলভীবাজার-রাজনগর আসনের সংসদ সদস্য সায়রা মহসিন হস্তক্ষেপ করেন এবং ‘ব্যস, আর নয়’ মর্মে ইউএনওকে নির্দেশনা দেন। কিন্তু ইউএনও বেপরোয়া। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগকে হাত করে করে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়তে থাকেন এবং একটি অনাস্থা প্রস্তাব বিভাগীয় কমিশনারের দফতরে পাঠান। শেষ পর্যন্ত কমিশনার দফতর অবশ্য তদন্ত করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে। কিছুদিন আগে এই ইউএনওকে সিলেটের অন্য এক উপজেলায় বদলি করা হয়েছে।

মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন সূত্র জানায়, শুধু নোয়াখালী, রাজনগর, কিংবা ঢাকা মহানগরীতেই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন ডিসি, এসপি ও ইউএনওরা ভাবভঙ্গিতে ‘আমিই পার্টির লিডার।’ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গ্রুপিং থাকায় এবং কিছু মন্ত্রী ও এমপির কারণে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তারা অতিমাত্রায় আওয়ামী লীগার হয়ে উঠছেন। তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, জনবিচ্ছিন্ন কিছু এমপি-মন্ত্রী নিজ জেলায় গিয়ে ডিসি-এসপি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসিদের দুই পাশে বসিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন। এসব এমপি-মন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে ডিসি-এসপি বা থানার ওসিদের ‘কাছের মানুষ’ মনে করেন। এই কর্মকর্তারাও স্থানীয় নেতাদের চেয়ে বেশি দলবাজি করছেন, স্থানীয় পর্যায়ে দলের সিদ্ধান্ত নেন। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের সময় বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা চেহারা বদলে ফেলেছিলেন। কেউ কেউ তো সরকার দলের প্রভাবশালী মন্ত্রীদেরও পাত্তা দেননি।  

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ও দুজন মন্ত্রী নাম নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ১৯৯৬ সালে দল ও সরকারের যে সমন্বয় ছিল বর্তমানে তা নেই। সমন্বয় অনেকটা কমে গেছে। আবার তৃণমূলেও এখন চাওয়া-পাওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে। দলের কিছু এমপি-মন্ত্রী পরীক্ষিত ত্যাগী নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে হাইব্রিডদের সঙ্গে দোস্তি করছেন। আবার ডিসি, এসপি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিদের ‘অপরিহার্য ডানহাত’ মনে করেন। ফলত এই কিসিমের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে অমনোযোগী এবং ওই এমপি-মন্ত্রীদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। পরিণামে অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো চলছে ধীরগতিতে।

সূত্রমতে, আগামী অক্টোবরের মধ্যেই জেলা প্রশাসক পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিসিএস ১৬, ১৮ ও ১৯ ব্যাচের ৩৫ জনের ফিট লিস্ট করা হয়েছে। ১৩তম ব্যাচের যারা আছেন, তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হবে।

সর্বশেষ খবর