বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নির্ঘুম রোহিঙ্গা ক্যাম্প

রাত নামলে শুধুই কান্নার শব্দ, মশা-মাছি বৃষ্টির দুর্ভোগ, গাড়ির আলো দেখলেই ত্রাণের আশায় ছোটাছুটি

মাহমুদ আজহার, রফিকুল ইসলাম ও ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজর) থেকে

নির্ঘুম রোহিঙ্গা ক্যাম্প

উখিয়ায় কুতুপালংয়ে গতকাল ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা। সড়কের পাশে ধানখেতের মাচায় জায়গা মিলিছে অনেকের —রোহেত রাজীব

তখন রাত পৌনে ৩টা। ধুমছে বৃষ্টি হচ্ছিল উখিয়ার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাজুড়ে। বাইরে থেকে দেখা যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সুনসান নীরব, নিস্তব্ধ। বাইরে ঝিঁঝি পোকা আর সমুদ্রের গর্জন স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ক্যাম্পের ভিতরে অন্য চিত্র। শিশুদের কান্না, তাঁবুর ছাউনি চুইয়ে পড়া পানির টুপটুপ শব্দ, মশা-মাছির আনাগোনায় অনেক শরণার্থীই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছিলেন। কেউ বা তাঁবুর ওপরে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়ায় ছিলেন ব্যস্ত। থেমে থেমে ভেসে আসছিল অসুস্থ রোগীদের গোঙানি আর হাঁচি-কাশির শব্দ— এমনই এক চিত্র দেখা গেল কুতুপালংয়ে সরকারের বরাদ্দ দেওয়া নতুন শরণার্থী শিবিরে। দুই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা এই ক্যাম্পের চারটি তাঁবুতে শতাধিক রোহিঙ্গাকে দেখা গেল, কেউ আধশোয়া, কেউ বসে কিংবা কোনো নারী বাচ্চাকে বুকে আগলে ধরে আছেন। কেউ বা বুকের দুধও খাওয়াচ্ছিলেন শিশুদের কান্না থামাতে। তবে এ চিত্র শুধু কুতুপালংয়েই নয়, উখিয়া থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ি বনভূমির ১২টি এলাকায় তাঁবুগুলোর ভিতরকার দৃশ্য প্রায় একই। ঘড়ির কাঁটায় রাত দেড়টা। কক্সবাজারজুড়েই তখন বৃষ্টি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি অনুসন্ধানী টিম কক্সবাজারের কলাতলী থেকে রওনা হয় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের দিকে। রাস্তায় নেই কোনো যানজট। মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে চলছিল অনুসন্ধানী টিমের গাড়ি। দিনের বেলায় ওই রোডে কয়েকটি স্থানে চেকপোস্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দেখা গেলেও মধ্যরাতে তা নেই। রেজু ব্রিজেও চেকপোস্ট বসানো কিন্তু কোনো বিজিবি সদস্যকে দেখা যায়নি। তবে কোর্টবাজার লিঙ্ক রোডের মোড়ে দেখা মেলে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের। এক পুলিশ কর্মকর্তা গাড়ি দেখামাত্রই সাংকেতিক চিহ্ন দেখিয়ে থামতে বলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পরিচয় দিলে উখিয়া যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে কুতুপালংয়ের দিকে। রাত সোয়া ২টার দিকে কুতুপালংয়ে পৌঁছে অনুসন্ধানী টিম। সেখানে দিনের বেলা ত্রাণের জন্য রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী দিগিবদিক ছোটাছুটির চিত্র লক্ষ্য করা যেত, রাতে ছিল ভিন্ন চিত্র। রাস্তার দুই ধারে ছিল না কোনো কোলাহল। তবে রাস্তায় দেখা যায় বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ত্রাণ দিতে আসা কিছু সংস্থার গাড়ি। কুতুপালং থেকে বালুখালী, থাইংখালী ও পালংখালী জুড়েই শরণার্থী শিবির। দিনের বেলায় সেখানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান নিয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় থাকে।

কুতুপালং থেকে যাওয়া হলো পালংখালী। পালংখালী বাজার থেকে একটু দূরেই মহাসড়কের পাশে ধান খেতের ওপরে শুয়ে থাকতে দেখা যায় তিন শিশু-কিশোরকে। ওপরে পলিথিন দিয়ে মোড়া ত্রিপল দেখা গেলেও টপটপ করে পানি ঝরছিল। চারদিক থেকেও দমকা বৃষ্টি গিয়ে পড়ছিল তাদের গায়ে। তারা হালকা বৃষ্টিতে ভেজা শরীরে শুয়ে থাকলেও দিনভর ক্লান্তশ্রান্ত থাকায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। এক কিশোর শুয়েছিল পুরো খোলা আকাশের নিচে। তার ওপর ঝরছিল অঝর ধারার বৃষ্টি। পালংখালী থেকে আসার পথে রাস্তার বাঁ পাশে একটি শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা যায়, এক বাবা বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। বাচ্চারা ঘুমুচ্ছে। তবে তাঁবুর একপাশ খোলা থাকায় মাঝেমধ্যেই হালকা বৃষ্টিতে বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে। মা এক বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবে বাচ্চাদের কান্নাকাটিতে তিনি বার বার সজাগ হয়ে যাচ্ছিলেন। ৮-১০ ফুট তাঁবুতে শিশুসহ ১৫ জন শরণার্থী শোয়া। পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাঁড়িপাতিল, পোঁটলা, ছাতাসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী। এক বাচ্চার পা দেখা যায় তাঁবুর বাইরে। এরপর থাইংখালী ও বালুখালীতে পাঁচটি শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা যায়, সব তাঁবুর ছিদ্র দিয়ে পানি ঝরছে। বয়োবৃদ্ধরা বসে আছেন। শিশুরা চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। হাঁচি, কাশি আর গোঙানির শব্দ বালুখালীর একটি তাঁবুতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রহিম উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধ পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। জানালেন, তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। পাহাড়ি ঢলের পানি খেয়েছেন। তাই পেট ব্যথা করছে। ওই ত্রাণশিবিরে ফাতিমা নামে আরেক মধ্যবয়সীর চারপাশে পাঁচটি বাচ্চা শুয়ে রয়েছে। এক শিশু বুকের দুধ খাচ্ছে আর মা হাত দিয়ে মশা-মাছি তাড়াচ্ছেন। বাকিরা মাকে জড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। টিমের গাড়ির আলো যখন ত্রাণশিবিরে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, তখন ঘুমহীন অনেকেই ছুটে আসতে শুরু করেন গাড়ির দিকে। তাদের ভাবনায় ছিল ত্রাণসামগ্রীর গাড়ি। এরপর অনুসন্ধানী টিম চলে আসে কুতুপালংয়ের নতুন শরণার্থী শিবিরে। মহাসড়ক থেকে ২ কিলোমিটার দূরে এই শিবির। বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত রাস্তায় গাড়ি মূল সড়কের অদূরে রেখে যেতে হয়। হেঁটে দুর্গম পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে রওনা দেয় টিম। এর মধ্যে পথে দেখা মেলে একটি শরণার্থী শিবিরের পাশেই পাহাড়ের ওপর বসানো হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার দেওয়া গভীর নলকূপ। রাতের অন্ধকারেই কাজ করতে দেখা যায় চার যুবককে। এ সময় তারা জানালেন, প্রায় ৬০০ ফুট গভীরে পাইপ বসানোর প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। সকালের আগেই এ নলকূপ ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হবে। তবে সরকারি নতুন শরণার্থী শিবিরে যখন পৌঁছি তখন রাত পৌনে ৩টা। দুই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা কয়েকটি আশ্রয়শিবির দেখা যায়। ইউএনএইচসিআরের লোগোসংবলতি তাঁবুগুলোর চারপাশই ছিল খোলা। বলা চলে কাদাপানির ওপরই তাঁবু করা হয়েছে। একটি তাঁবুতে কথা হয় বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন, মধ্যবয়সী সালমা খাতুন, রেহেনা বেগম, নাজুমা বেগম ও জ্বরে আক্রান্ত কামাল হোসেনের সঙ্গে। না ঘুমিয়ে কেন বসে আছেন, জানতে চাইলে রাবেয়া খাতুনের উত্তর— ‘বেশ কয়েক দিন ধরে নামাজ আদায় করতে পারছি না। ঠিকমতো গোসল-খাওয়া হচ্ছে না। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বৃষ্টিপাত। তাই ঘুমাতে গেলেও নানা চিন্তায় আর ঘুম আসে না দুই চোখে। বসে-শুয়ে কোনোরকমে কাটিয়ে দিচ্ছি রাত।’ নাজুমা বেগম বলেন, ‘গত তিন দিন রাস্তার ধারে ছিলাম। সেখানে তাঁবু ভেঙে দিলে এই জায়গাটিতে আশ্রয় নিই।’ জ্বরাক্রান্ত ছেলে কামাল হোসেনকে দেখিয়ে বললেন, ‘তিন দিন ধরে জ্বর ওর। ওষুধপথ্য জোটেনি এখনো। ছেলেটিকে পাহারা দিয়েই রাত কাটাই।’

দেড়-দুই বছরের এক অসুস্থ শিশুকে কোলে নিয়ে অদূরে বসা সালমা বেগম। করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘তাঁবুর ওপরে ত্রিপল দিয়ে বৃষ্টির পানি কিছুটা বন্ধ করা গেলেও নিচে কাদাপানি জমে থাকায় গত তিন দিন তেমন ঘুমাতে পারছি না। এখানে আসার পর থেকেই দুই ছেলের কাশি লেগে আছে। তাদের নিয়ে আছি দুশ্চিন্তায়। এ অবস্থায় মা হয়ে কি ঘুমাতে পারি!’

রোহিঙ্গা শরণার্থী হাবিবুল্লাহ। জানালেন, ‘আগে রাস্তার পাশে ছিলাম বলে কিছু কিছু ত্রাণ-সাহায্য পেয়েছিলাম। এখানে এত ভিতরে আমাদের নিয়ে আসা হলো যে, কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি না আমরা। কীভাবে যে দিন কাটাব জানি না।’

তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘড়িতে ভোর ৪টা ছুঁই ছুঁই। ক্যাম্পের নির্জনতা ভেঙে কিছুটা দূর থেকে কানে আসে কয়েকজন নারী-পুরুষের মৃদু আওয়াজ। একটা হালকা আলোর বিচ্ছুরণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটু পরই বোঝা গেল দূরের কোনো ক্যাম্প থেকে বালুখালীর তীরে এসে দাঁড়িয়েছেন তারা। বালুখালীতে তখন ঢলের প্রবল স্রোত। ঘোলা পানির কলকল আওয়াজ। কাছে গিয়ে তাদের ভাষায় জানতে চাইলাম— রাত শেষ হতে এখনো তো অনেক বাকি। এর পরও কেন আপনারা খালের তীরে কাপড়-চোপড় ও বাসন-কোসন নিয়ে এলেন। জবাবে দুই বোন সাইদা ও সাদিকা বেগম বললেন, ‘সকাল হলেই প্রচুর লোক এখানে গোসল ও ধোয়ামাজা করতে আসেন। সে সময় বেশ লজ্জা হয়। তাই আঁধার থাকতেই গোসল সেরে এলাম।’ তারা যখন কথা বলছিলেন তখন মনে হয় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে।

ভোর সাড়ে ৪টায় একটি তাঁবুর কিনার থেকে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি। আজান দিয়েছিলেন মাওলানা সৈয়দ হোসাইন। ইনি ছিলেন মংডুর উকিলপাড়ায় একটি মসজিদের ইমাম। তিনি জানান, ‘এখনো তাঁবুতে কোনো নামাজের ব্যবস্থা নেই। একটি খালি তাঁবু পেলেই নামাজের জায়গা করে নেওয়া যেত। আশ্রয়শিবিরে কোনো পরদার ব্যবস্থা না থাকায় মহিলাদেরও নামাজের ব্যবস্থা নেই।’ মাওলানা সৈয়দ হোসাইনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আকাশ ফরসা হয়ে উঠছিল। প্রাত্যহিক ও প্রাকৃতিক কার্যাদি সারতে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে মানুষ। পাদদেশ থেকে পাহাড়ের ওপরে উঠতেই দেখা গেল খোলা আকাশের নিচে পলিথিনকে জায়নামাজ বানিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা। এ সময় শুরু হয় আবারও বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজেই তারা সিজদায় অবনত হলেন।

বৃষ্টিতে তাঁবু ফেলে রাস্তায় শরণার্থীরা : গতকাল দিনভর বৃষ্টিতে তাঁবুর ভিতরে পানি জমে যাওয়ায় উখিয়া-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে অবস্থান নেন শরণার্থীরা। শুধু ত্রাণই নয়, রাস্তার পাশেও মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজেন তারা। রাতদিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ের ওপরে ও পাদদেশে থাকা অধিকাংশ তাঁবুতে জমে হাঁটুপানি। পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে অনেক তাঁবু। বালুখালীতে বাঁশের তৈরি সাঁকোটিও ভেঙে পড়ে। এতে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ক্যাম্পের একটি বড় অংশের।

সর্বশেষ খবর