বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
জাতির উদ্দেশে ভাষণ

সু চির মুখে নতুন সুর

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

সু চির মুখে নতুন সুর

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি জানেনই না, কেন তার দেশ থেকে লাখে লাখে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। তিনি গতকাল মিয়ানমারে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, মুসলিমরা কেন চলে যাচ্ছে সেটি খুঁজে বের করার জন্য তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। অবশ্য অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে থাকা সু চি গতকাল দেওয়া ভাষণে নতুন সুর নিয়েছেন। বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার জন্য যারা দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটাতে সেনাবাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত করে ফেরত নেওয়ার কথাও ভাষণে উল্লেখ করেছেন অং সান সু চি। তবে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের পর্যবেক্ষণে ভীত নয় মিয়ানমার। ২৫ আগস্ট নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর এই প্রথম কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসেবে নোবেল পুরস্কারজয়ী সু চির কাছ থেকে। এমনকি জাতিসংঘে চলমান সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেননি মিজ সু চি। তিনি বলেছিলেন, অধিবেশনে যোগ না দিয়ে মিয়ানমারে ভাষণ দেবেন। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তার এই ভাষণ। বাংলাদেশ সময় গতকাল সকালে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, ‘বেশ কিছু মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে—এ ধরনের খবর শুনে আমরা উদ্বিগ্ন। রাখাইনে যে কোনো ধরনের বেআইনি সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানাই। অন্যের ওপর দোষারোপ কিংবা দায় অস্বীকার করা মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য নয়। যারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে যেভাবে বলা হচ্ছে, সেভাবে সব মুসলিমের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়নি। অধিকাংশ মুসলিম রাখাইন অঞ্চলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এতে বোঝা যায় সেখানে পরিস্থিতি খুব মারাত্মক নয়।’ রাখাইন অঞ্চলে সংঘাতের নিরসনের জন্য একটি  টেকসই সমাধানের ওপর জোর দেন সু চি। তিনি বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক চাপকে ভয় করি না। পরিস্থিতি দেখার জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে রাখাইন পরিদর্শনে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে রাখাইন নিয়ে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার কাজ করবে। আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই। আমরা রাজ্যে (রাখাইন) শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ আছে এবং আমাদের সবই শুনতে হবে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে এই অভিযোগগুলো যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে করা হচ্ছে কি না, তা আমাদের নিশ্চিত হতে হবে।’ ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান সু চি বলেন, ‘আমরা নতুন (গণতন্ত্র) ও ভঙ্গুর দেশ, যাতে বহু সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটা শুধু রাখাইন রাজ্যে নয়, আরও বহু জটিলতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। আমাদের এর সবগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের শুধু অল্প কিছু বিষয়ের ওপর নজর দিলে হবে না।’ সামপ্রতিক বছরগুলোতে রাখাইনে বসবাসরত মুসলিমদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সু চি উল্লেখ করেন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি শরণার্থী সংকট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপকভাবে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে সু চি বলেন, ‘আজকের বিশ্বের অভিশাপ ঘৃণা ও আতঙ্ক। আমরা চাই না মিয়ানমার এমন একটি দেশ হোক, যেটি হবে ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে বিভাজিত।’ সহিসংতার মুখে যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তাদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে সু চি বলেন, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ যে কোনো সময়ই প্রস্তুত রয়েছে।

সেনাবাহিনী নিয়ে কথা বলেননি সু চি : মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা তার ভাষণে খানিকটা দৃঢ় কণ্ঠে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আইনবহির্ভূত কাজের নিন্দা করেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। কোনো কথা বলেননি রাখাইনে অব্যাহত সেনা নির্যাতনের। বিবিসির মিয়ানমার সংবাদদাতা জোনা ফিশার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, অং সান সু চির হয়তো বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, নতুবা তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি যে কথা বলেছেন, সেটি এত সহজ নয়। কারণ মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে তাদের কাগজপত্র দিতে হবে। অথচ সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে কোনো কাগজপত্র দেয়নি। বিবিসির সাংবাদিক জোনাথন হেড বলছেন, সু চি তার ভাষণে বলেছেন, সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখের পর থেকে রাখাইনে কোনো অভিযান চালানো হয়নি। কিন্তু এ বিষয়টি সত্য নয়। অথচ সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখের পর জোনাথন হেড মিয়ানমার সরকারের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে গিয়েছিলেন, তখন তিনি সেখানে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে দেখেছেন।

গণ-আদালতে সু চি ও মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বিচার শুরু : মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামে  একটি গণ-আদালতে সোমবার বিচার শুরু হয়েছে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি ও দেশটির সেনাবাহিনীর। গণহত্যার অভিযোগে সোমবার সেখানে প্রথম শুনানি হয়। কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে অনুষ্ঠিত এ শুনানিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল অংশ নেয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটন জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্য বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকার অভিযুক্ত। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও ওই শুনানিতে অংশ নেন। আজ ট্রাইব্যুনালে মিয়ানমারে মুসলিম নিপীড়ন বিষয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। বিকালে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সমাপনী বক্তব্য শেষে বিবাদীপক্ষ বক্তব্য রাখবে। আগামীকাল দিনভর বিচারকমণ্ডলীর সদস্যরা তাদের বক্তব্য পেশ করবেন।

সু চির ভাষণ মিথ্যাচারে ভরা : ভাষণে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি প্রকৃত সত্য লুকিয়ে বিশ্ব সমপ্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গাদের এক নেতা। ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের (ইআরসি) প্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ বিডিনিউজকে বলেছেন, রাখাইনে সেনাবাহিনী যে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে, তা আড়াল করার প্রয়াস চালিয়েছেন সু চি, দিয়েছেন নানা ‘মিথ্যা তথ্য’।

রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে না গিয়ে গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি। তাতে তিনি কারও নাম না ধরে রাখাইনে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানান। ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেননি; সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও সরাসরি কিছু বলেননি।

সেনা অভিযানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষণ এবং ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান আসা শরণার্থীরা। জাতিসংঘ একে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে আখ্যায়িত করে; নিন্দা আসে সারা বিশ্ব থেকে।

এর মধ্যেই সু চির ভাষণের পর নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে ইউরোপে জনমত গঠনে সক্রিয় ইআরসির নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ টেলিফোনে বিডিনিউজকে প্রতিক্রিয়া জানান।

তিনি বলেন, ‘আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তাই ঘটেছে। অং সান সু চি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন’।

আট সদস্যের বিচারক প্যানেলে রয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আইনজীবীরা।

পিপিটি মালয়েশীয় শাখার সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি চন্দ্র মোজাফফর বলেছেন, পাঁচ দিনের অধিবেশনে বিচারকরা প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক, বিশেষজ্ঞ সাক্ষীদের মতামত, ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় রায় ঘোষণা হবে। বিচারকদের এ রায় জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও গোষ্ঠীর কাছে পাঠানো হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর