বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ২০

এক ফিঙ্গার প্রিন্টেই খুনের রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

এক ফিঙ্গার প্রিন্টেই খুনের রহস্য

অভিজাত এলাকা গুলশান। এক নম্বরের ৭ নম্বর রোডের একটি ফার্নিচারের দোকানের দেয়াল ঘেেঁষ পড়ে আছে এক তরুণীর লাশ। রক্তাক্ত। পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত। রাতের আঁধারে কে বা কারা লাশটি ফেলে চলে যায়। লাশ ঘিরে উত্সুক মানুষের ভিড়। রাজধানীর অন্যতম একটি নিরাপত্তা বেষ্টিত এলাকায় লাশ পড়ে থাকার খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ আসে। আসে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। পুলিশ লাশ দেখে প্রায় নিশ্চিত, অন্য কোথাও হত্যার পর লাশ সেখানে ফেলে রেখে যায় খুনিরা। ঘটনাস্থলে খুন করার কোনো আলামত খুঁজে পাওয়া যায় না। পুলিশের এক কর্মকর্তা ভালোভাবে অজ্ঞাত তরুণীর চেহারা লক্ষ্য করেন। আঁতকে উঠলেন তিনি! আরে এতো আদিবাসী সম্প্রদায়ের মেয়ে! এটা নিয়ে তো দেশে আরেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। রাতের আঁধার কেটে যাওয়ার পর দিনের আলোয় যখন বিষয়টি উঠে আসল, সারা দেশ তোলপাড়। আদিবাসী নেতারাও ক্ষুব্ধ। তরুণীর নাম পরিচয় জানা না থাকলেও আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা থানায় গিয়ে খুনিদের গ্রেফতারে চাপ দিতে থাকেন। গুলশান থানা পুলিশ এই লাশের পরিচয় বের করার চেষ্টা চালাতে থাকে। পুলিশ যখন তরুণীর নাম পরিচয় বের করতে ব্যর্থ, ঠিক তখনই তদন্তে আশার আলো দেখায় জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন ও অনুবিভাগের ফিঙ্গার প্রিন্ট। তরুণীর লাশের ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমেই তার আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে। পুলিশ জানতে পারে, তরুণীটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের নয়। রংপুরের মেয়ে কাজলী। একই সূত্রে ধরা পড়ে কাজলীর খুনি দুই সপ্তাহের ব্যবধানে। একজনের ফিঙ্গার প্রিন্টেই লাশের পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি খুনি সুজন বিশ্বাসও ধরা পড়ে। আর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে লাশ শনাক্তের ঘটনা এটি প্রথম। তরুণীর লাশ উদ্ধার নিয়ে তোলপাড় শুরু হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে এক নির্মম প্রেম কাহিনী।

২০১৬ সালের ৫ মার্চ রাজধানীর গুলশান-১ এর ৭ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর বাড়ির মর্ডান ফার্নিচারের দেয়ালের কাছে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার শরীরে অসংখ্য ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। কিন্তু নিহত তরুণীর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল না। নিহত তরুণীর মুখমণ্ডল উপজাতীয় তরুণীর মতো হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার উপজাতীয় গোষ্ঠীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাতেও পরিচয় না পাওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন ও অনুবিভাগের মাধ্যমে লাশের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়। পরে ওই ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে তার জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। সেই পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে গত ১৭ মার্চ রংপুর জেলার বদরগঞ্জের কাজিরহাট এলাকার ছকিম উদ্দিনের ছেলে ওবায়দুল হক ঢাকায় এসে নিহত তরুণীকে তার বোন হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে জানা যায়, নিহত তরুণীর নাম কাজলী বেগম ওরফে কাজল (২৪)। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, নিহতের পরিচয় শনাক্তের পর শুরু হয় হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের অভিযান। গুলশান থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) সালাউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানমন্ডি এলাকা থেকে সুজন বিশ্বাস নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। আর এই গ্রেফতারেও রয়েছে নাটকীয় নানা কাহিনী। যা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সুজন একটি পার্লার কাম সেলুনের গাড়ি চালাত। ওই পার্লারে যাতায়াত ছিল কাজলের। এতে দুজনের মধ্যে পরিচয় হয়। পরিচয়ের একপর্যায়ে দুজনেই মেলামেশা শুরু করে। কাজল জিগাতলার একটি বাসায় ভাড়া থাকত। কাজলের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করত সুজন। একদিন সুজন ফোন করে কাজলের বাসায় যেতে চায়। কাজল সেদিন সুজনকে বাসায় যেতে নিষেধ করে। এতে সুজনের সন্দেহ হয়। কাজল সম্পর্কেও তিনি বিভিন্ন লোকের মুখে নানা কথা শুনে ভিতরে ভিতরে কাজলের ওপর ফুঁসতে থাকে। গত ৪ মার্চ কৌশলে বেড়ানোর কথা বলে কোম্পানির মাইক্রোবাসে কাজলকে তুলে নেয় সুজন। তারা এক সঙ্গে সংসদভবন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। পরে রাত ১০টার দিকে সুজন তাকে মহাখালীর চ-২১৪ টিবি গেটের বাসায় নিয়ে যেতে চায়। এতে কাজল রাজি হলে সুজন তাকে মাইক্রোবাসে করে কৌশলে বিজয় সরণি ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে গাড়ির দরজা বন্ধ করে সুজন কাজলকে ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। পরে গাড়িতে করে লাশ নিয়ে গুলশানে নিয়ে ফেলে দেয়। এ সময় তাকে সহায়তা করে চান্দু নামে এক বন্ধু।

হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সুজন গাঢাকা দেয়। ধানমন্ডির একটি বাসায় আত্মগোপন করে থাকে। এ খবর শুধু জানে তার বন্ধু চান্দু। সুজনও তার মোবাইল ফোন চান্দুর কাছে দিয়ে রাখে। সে নতুন একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এদিকে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে সুজনের নাম। সুজনের ফোন নম্বরও জোগাড় করে। পুলিশ সুজনকে ফোন দেয়। ফোন ধরে চান্দু। চান্দু জানায়, সুজন এই নম্বরে আর নেই। পুলিশ নিজের পরিচয় গোপন রেখে একটি প্রাইভেট কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। কোম্পানিতে ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়া হবে বলে পুলিশ তাকে জানায়। তাই সুজনকে খুব দরকার। চাকরির খবরে লোভে পড়ে যায় চান্দু। চান্দু নিজেকেই সুজন বলে পরিচয় দেয়। পরদিন দেখা করে ছদ্মবেশী পুলিশের সঙ্গে। পুলিশ তাকে সুজন ভেবে ধরে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে স্বীকার করে সে চান্দু। সুজনের বাসায় নিয়ে যায়। সুজনকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে খুনের অজানা কাহিনী। সে  হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর