বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জাতিসংঘের দ্রুত পদক্ষেপ চান ট্রাম্প

ব্রিটেনে সু চির সম্মাননা স্থগিত, মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা

প্রতিদিন ডেস্ক

জাতিসংঘের দ্রুত পদক্ষেপ চান ট্রাম্প

মিয়ানমারে জাতিসংঘের বলিষ্ঠ ও দ্রুত পদক্ষেপ চেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।  জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন বলেছেন, মিয়ানমারের ওপর এখনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। অন্যদিকে,  রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও মানবিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে অং সান সু চিকে দেওয়া সম্মাননা স্থগিত করেছে ব্রিটেনের অন্যতম বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন। এর নাম ইউনিসন। মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রচারাভিযানের সময় অং সান সু চি কারাবন্দী থাকাকালে ২০১০ সালে তাকে এ সম্মাননা দিয়েছিল ইউনিসন। ইউনিসন বলছে, তারা সু চিকে দেওয়া সম্মাননাসূচক সদস্যপদ স্থগিত করেছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য ব্যবস্থা নিতে সু চির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

ইউনিসন সভাপতি মার্গারেট ম্যাককি ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই হতাশাজনক। এ অবস্থায় অং সান সু চির ইউনিসনের সম্মানিত সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক চাপের প্রতি তিনি সাড়া দেবেন।’ শুধু তাই নয়, ব্রিটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান সু চিকে যে সম্মানসূচক পুরস্কার বা পদ দিয়েছিল তাও কেড়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।

সামরিক জান্তার নিষ্পেষণে থাকা অবস্থায় অং সান সু চি গণতন্ত্রের জন্য যে লড়াই করেছিলেন সেজন্য তাকে সম্মানসূচক পদ দেয় বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রোহিঙ্গা নির্যাতনের  কারণে বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার পর সু চিকে দেওয়া সেই সম্মাননা স্থগিত বা বাতিল করার বিষয় বিবেচনা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। গার্ডিয়ান লিখেছে, বিরোধী দলে অর্থাৎ সরকারের বাইরে থাকাকালে সু চিকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দিয়েছিল ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি। ব্রিটেনের ভালো অনেক ইউনিভার্সিটির অন্যতম এটি। তারা বলেছে, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতাকে জাতি নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা সু চিকে দেওয়া ওই সম্মাননার বিষয়ে রিভিউ করছে। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির এক মুখপাত্র বলেছেন, মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের সঙ্গে অভিন্ন অবস্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ওই মুখপাত্র আরও বলেছেন, ‘অং সান সু চি মিয়ানমারে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এজন্য ১৯৯৮ সালে তাকে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিগ্রি ডক্টর অব লজ প্রদান করে। কিন্তু এই সম্মাননা এখন কেড়ে নেওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে ভুল। তবে আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখব।’ এ ছাড়া সু চিকে সম্মানসূচক প্রেসিডেন্সি পদক দিয়েছিল দ্য লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ছাত্র ইউনিয়ন। তারা বলেছে, তারাও ওই সম্মাননা কেড়ে নিতে পারে। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতির পাশা বলেন, ‘বর্তমানে যে গণহত্যা চলছে এবং তাতে সু চির নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে তিনি আমাদের বিরোধী প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তাই আমরা অং সান সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক প্রেসিডেন্সি খেতাব কার্যকরভাবে প্রত্যাহার করে নেব।’

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের বলিষ্ঠ ও দ্রুত পদক্ষেপ চান ট্রাম্প : অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মুখ খুললেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকটের অবসানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ‘বলিষ্ঠ ও দ্রুত’ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্যের কথাবার্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে গতকাল নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বক্তব্যে পেন্স মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তা না করা হলে ‘এটা ঘৃণা ও বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করবে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ওই অঞ্চলকে ধ্বংস করতে পারে এবং আমাদের সবার জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে’ বলে সতর্ক করেছেন তিনি।

এখনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত : মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে দেশটির ওপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এখনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির (জাতিসংঘ) মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন থেকে পালিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের পর থেকেই সোচ্চার এই কর্মকর্তা। তবে মিয়ানমার সরকার পাল্টা অভিযোগ করেছে, ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিরা’ই এমন সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের এই অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে হুসেইন বলেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য কয়েকজন রোহিঙ্গা চরমপন্থির কার্যক্রমের উদাহরণ একটা অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নতুন করে আলোচনা, সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করবে ব্রিটেন : হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে একটি জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে মিয়ানমার। এ অবস্থায় বিশ্বের অনেক দেশ ও সংগঠন দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি আলোচনা করছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের অবকাশে থেরেসা মে এ ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক চাপ তো বাড়ছেই। থেরেসা মে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বন্ধ রাখা হবে।’ ব্রিটিশ সংসদের ১৫৭ জন সদস্য রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত রাখার আহ্বান জানানোর পর থেরেসা মে এ ঘোষণা দিলেন। এর আগে গত সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফ্যালন মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বন্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। গত বছর ব্রিটেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে ২ লাখ ৫ হাজার পাউন্ড খরচ করেছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য মার্কিন ও সৌদি আর্থিক সহায়তা : মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার দেবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য দেড় কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। মঙ্গলবার সৌদি সংবাদমাধ্যম আরব নিউজের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। গতকাল সচিবালয়ে বার্নিকাট বলেন, মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তায়ও ৩৫ লাখ ডলার দেওয়া হবে। নতুন এ সহায়তা নিয়ে এ বছর মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত ও সেখান থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ সাড়ে ৯ কোটি (৯৫ মিলিয়ন) ডলারে দাঁড়াচ্ছে বলে জানান বার্নিকাট। মার্কিন সহায়তার এই অর্থ দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়স্থান, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হবে। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।

সু চিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অং সান সু চির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম সু চির সঙ্গে কথা বললেন তিনি। এ সময় রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতি ও বাড়িছাড়া মানুষগুলোকে ঘরে ফেরার সুযোগ দেওয়ার ঘোষণাদানের পদক্ষেপকে স্বাগত জানান টিলারসন। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি। এতে বলা হয়, এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিদার নুয়ার্ট। তিনি বলেছেন, টিলারসন মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আক্রান্ত এলাকাগুলোয় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মারাত্মক অপরাধের অভিযোগের বিষয়টি আমলে নেওয়ার। বর্তমানে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে নিউইয়র্কে রয়েছেন টিলারসন। এই জাতিসংঘেই মিয়ানমারের তীব্র সমালোচনা করছেন বিশ্বনেতারা। ওদিকে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমারে আক্রান্ত এলাকায় জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের প্রবেশের অনুমতি দিতে সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন টিলারসন।

সু চির ভাষণ প্রত্যাখ্যান ১৪ দলের : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। এই জোটের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সু চির দেওয়া কোনো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তার বক্তব্য জোটের পক্ষ থকে প্রত্যাখ্যান করছি। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন। সভায় বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার সংঘনায়ক, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি শুদ্ধানন্দ মহাথেরোর সভাপতিত্বে ১৪ দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, যারা নিজ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে, আমরা ১৪ দলের পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা করছি। আমরা নিন্দা জানাই সু চির আজকের এই ভূমিকাকেও। তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়ে কীভাবে এই নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন?’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আজকে আমরা আশা করব বিশ্ববাসী জেগে উঠবে, চাপ সৃষ্টি করবে মিয়ানমারের ওপর। তারা যেন এই নিরীহ মানুষদের ফিরিয়ে নেয়, তাদের যেন নিজের দেশের আশ্রয় পাওয়ার ব্যবস্থা করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে অনুরোধ করব তারা যেন এগিয়ে আসে। এই নিরীহ মানুষের দিকে তাকিয়ে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করার জন্য।

সর্বশেষ খবর