বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ২১

লাশ ছিল ডিপ ফ্রিজে

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশ ছিল ডিপ ফ্রিজে

ছয় বছরের শিশু সামিউল আজিম। এক সকালে হঠাৎ নিখোঁজ। মাঠে খেলতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেনি। সামিউলের বাবা তার সন্তানকে না পেয়ে পাগলপ্রায়। সব জায়গায় খুঁজছেন। তার মা আয়শা হুমায়রাও ছটফট করছেন। থানায় জিডি হলো। মাইকিং হলো এলাকায়। কিন্তু ফুলের মতো ছেলেটিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুই দিন পর খেলার মাঠে বস্তাবন্দী একটি শিশুর লাশ পাওয়া যায়। শিশুটির দুই পা বস্তা থেকে বেরিয়ে ছিল। লোকমুখে শুনতে পেয়ে সামিউলের বাবার মনে অজানা আশঙ্কা। তার ছেলের লাশ নয়তো! ছুটে যান তিনি। বস্তার মুখ খুলেই ভিতরে তাকান। সামিউলের লাশ! চিৎকার দেন তিনি। পুরো এলাকায় এ নিয়ে হৈচৈ। পুলিশ আসে। সামিউলের লাশ উদ্ধারের খবর পৌঁছে যায় তাদের ফ্ল্যাটেও। সামিউলের মা শুনেই দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। কিন্তু তার হাতে বড় ব্যাগ! ব্যাগ নিয়ে গেটের দিকে দৌড়াচ্ছেন। সিকিউরিটি গার্ড তাকে থামায়। আটকে দিল। পুলিশ তদন্ত করে। সামিউল খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে সমাজ বিরুদ্ধ এক নষ্ট প্রেমের গল্প। পরকীয়ায় এমনভাবেই মত্ত ছিলেন আয়শা, সমাজ সংসার সন্তান লোকলজ্জা-কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তার সামনে। পরকীয়ার বাধা হয়ে দাঁড়ানো নিজ শিশুসন্তানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা পর্যন্ত করেন। প্রেমিককে নিয়ে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নও ঘটান নিজ বাসাতেই। শুধু তাই নয়, গুম করতে শিশু সন্তানের লাশ নিজ হাতে বস্তায় ভরে প্রথমে ডিপ ফ্রিজে রাখেন। পরে সময়-সুযোগ মতো বস্তাবন্দী লাশ তুলে দেন প্রেমিকের হাতে। ২০১০ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর আদাবরে শিশু সামিউল নিখোঁজ ও খুনের ঘটনাটি সারা দেশে আলোচিত হয়। তোলপাড় শুরু হয় সর্বমহলে। ঘাতক মা ও তার প্রেমিকের ফাঁসির দাবি করা হয়। পুলিশ সন্তান হন্তারক মা আয়শা ও তার প্রেমিককে গ্রেফতার করে। দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। কিন্তু জামিন পাওয়ার পর প্রেমিক বাক্কু পালিয়ে যান। তার এখন আর খোঁজ নেই। আর ঘাতক মা আয়শাও রয়েছেন জামিনে। তার স্বামীর সঙ্গেই একসঙ্গে আছেন বলে জানা গেছে। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবসায়ী কে এম আজিম ও আয়শা হুমায়রার ছেলে সামিউল মোহাম্মদপুরের গ্রিনউড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্লে গ্রুপে পড়ত। আদাবরের নবোদয় হাউজিং  সোসাইটির আট নম্বর সড়কের সাত নম্বর ভবনের পাঁচতলায় বসবাস ছিল পরিবারটির। পুলিশের কাছে আয়শা সবকিছু বলার পর পুলিশ আরিফ ওরফে বাক্কুকে গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। কিন্তু তার খোঁজ মিলছিল না। র‌্যাব এ সময় বাক্কুর স্ত্রী সাথীকে গ্রেফতার করে। সাথীর দেওয়া তথ্যে বাড্ডা এলাকা থেকে বাক্কুকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় বাক্কু হত্যার কথা স্বীকার করেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বার বার প্রতারণা করা সত্ত্বেও বাক্কুকে ছাড়তে পারেননি আয়শা। একবার পালিয়ে চলে গেলেও আবার ফিরে আসতে হয়েছে। বাক্কু তাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং করতেন। বার বার ছুটে যেতেন আয়শা তার কাছে। শেষবার বাক্কু তার জীবনে আসেন সুনামির মতো। আয়শাও নিজেকে ভাসিয়ে দেন তাতে। সন্তান হত্যার মতো পরিকল্পনাও করে ফেলেন তিনি। বাক্কু পুলিশ, র‌্যাব ও আদালতে বর্ণনা করেন সে রাতের খুনের ঘটনা। তিনি তার জবানিতে বলেছেন, ‘‘এশা (আয়শা হুমায়রা) আমাকে বলে, ছলেটা বাড়াবাড়ি করছে। বাবাকে বলে দেবে বলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে। এ কারণে আমরা সামিউলকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করি। ১৯ জুন রাতে আমি সামিউলের গলা টিপে ধরি। এশা এ সময় সামিউলের পা ধরে রাখে। গলা টেপার পরও তার মৃত্যু না হওয়ায় বালিশচাপা দিই। সামিউল মারা যায়। আমাকে এশা ছাদে পাঠিয়ে দেয়। আমি ওই রাতে ছাদে চলে যাই। পরদিন ভোরে এশাদের ফ্ল্যাটে যাই। পরে ওই ভবন থেকে বের হই। ভোরে এশা আমাকে জানায়, লাশ গুমের জন্যে আপাতত সামিউলের লাশ ফ্রিজে রেখে দিছি। শুনে আমি তাকে বলি, এই তো ভালো মেয়ের মতো কাজ করেছ। সুবিধাজনক সময়ে লাশ ফেলে আসি।”

সামিউল হত্যার বিচার : প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারাগারে থাকা স্ত্রী আয়শার বিরুদ্ধে বাদী আজিম আদালতে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর তিনিই স্ত্রীকে জামিনে মুক্ত করতে আদালতে একটি এফিডেভিট দেন। চলতি বছর ২ এপ্রিল ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ দায়রা জজ আমিনুল হক তার জামিন মঞ্জুর করেন। কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার পর তারা রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় একসঙ্গে বাসা নিয়ে সংসার করছেন খন্দকার আজিম ও আয়শা। স্ত্রীকে জামিনে বের করার জন্য আদালতে দেওয়া এফিডেভিটে কে এম আজিম উল্লেখ করেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী আয়শার মধ্যে এখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিদ্যমান। বর্তমানে আমার শারীরিক অবস্থা খারাপ। আমাকে দেখার মতো কেউ না থাকায় আমার সেবাযত্নের জন্য আমার স্ত্রীর পাশে থাকার প্রয়োজন বোধ করছি। তাই প্রয়োজনে আমার জিম্মায় তার জামিন মঞ্জুর করা হোক।’ আদালত এই এফিডেভিটের ভিত্তিতে এবং দ্রুত মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় জামিন মঞ্জুর করে। মামলার অপর আসামি আয়শার প্রেমিক আরিফ ওরফে বাক্কু ২০১৪ সালের ৮ এপ্রিল হাই কোর্ট থেকে জামিন পান। কারাগার থেকে বেরিয়েই লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর আয়শা ও বাক্কুর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। মামলাটিতে ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে দুই আসামির বিচার শুরু হয়। মামলাটিতে বাদী, ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক এবং তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।

পুলিশ জানায়, ২০০৩ সালের আজিমের সঙ্গে আয়শার বিয়ে হয়। এরপর থেকে তারা আদাবর থানার ৮ নম্বর রোডের নবোদয় হাউজিং-এর ৭ নম্বর বাসার ৫ম তলার ৫/এ ফ্লোরে থাকতেন। এ সময়ই বাক্কুর সঙ্গে পারলারে আয়শার পরিচয়। পরে বাক্কুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। স্বামীর অজান্তে বাক্কুকে ১৫ লাখ টাকা ধারও দেন আয়শা। আর বাক্কুর সঙ্গে আয়শার ঘনিষ্ঠতা দেখে ফেলায় খুন করা হয় সামিউলকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর