শিরোনাম
শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সু চিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায় আজ

বিশ্বজনমত মিয়ানমারের বিপক্ষে, ব্রিটিশ এমপিদের সংবাদ সম্মেলন জাতিসংঘে সাফাই, ক্ষোভ নিন্দা অব্যাহত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

সু চিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায় আজ

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা, নির্যাতন করে বিতাড়নের অপরাধে সে দেশের নেত্রী অং সান সু চি ও তার সামরিক সহযোগীদের মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুপারিশ করেছেন আন্তর্জাতিক গণআদালতের বিশেষজ্ঞ সাক্ষী ও বাদীপক্ষের কৌঁসুলিরা। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে গঠিত এই গণআদালতে ইতিমধ্যে শুনানি শেষ হয়েছে। আজ সকাল ১০টায় রায় ঘোষণা করবেন ট্রাইব্যুনালের সভাপতি আর্জেন্টাইন বিচারক। শুধু এ গণআদালতই নয়; বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দাবি উঠেছে মিয়ানমার নেতৃত্বের বিচারের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর কয়েক দিনের মধ্যেই রাখাইনে গণহত্যার চিত্র পরিষ্কার হবে। তবে সেখানে যে জাতিগত নিধন চলছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছে সফররত ব্রিটিশ ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির পার্লামেন্ট সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের বিপক্ষে জোরালো বিশ্ব জনমত   গড়ে উঠেছে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বনেতারা একে একে নিন্দা জানিয়েছেন মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যার। ফরাসি টেলিভিশন চ্যানেল টিএমসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রেঁদ্ধা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারে যে নৃশংসতা ও নিপীড়ন চলছে তাকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি এ গণহত্যা বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। প্রায় একই আহ্বান তিনি জাতিসংঘেও জানিয়েছেন। অবশ্য এবারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। সংকট নিরসনে জাতিসংঘকে জোরালো পদক্ষেপের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান, তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশ রাখাইন সংকট উত্তরণে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে এ সংকট নিরসনে বেশ কিছু বৈঠক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটের অবসানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে ‘বলিষ্ঠ ও দ্রুত’ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বক্তব্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংসতা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া ও রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেন। মূল আলোচনার বাইরে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বুধবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে তুরস্কসহ অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং বিপন্ন ওই জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিতের ব্যাপারে আলোচনা করেন তারা। আলোচনায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রাখাইন পরিস্থিতিকে সিরিয়ার সঙ্গে তুলনা করেন। সেখানে চলমান জাতিগত নিধনযজ্ঞ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান তিনি। এর আগে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক সচিব বরিস জনসন রাখাইনের সংকট উত্তরণে বেশ কিছু বৈঠক করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারে চলমান সংকটকে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন তার উদ্বোধনী ভাষণে।

অবশ্য তীব্র আন্তর্জাতিক সমালোচনার পরও মিয়ানমার নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েই চলেছে। জাতিসংঘে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাখাইনে সংকট কমছে। মিয়ানমার জাতিসংঘকে জোর দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে যে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেশটির দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ভ্যান থিও এ কথা জোর দিয়ে বলেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির পরিবর্তে জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেন থিও। সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মিয়ানমার থেকে পালানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে থিও অনেকটা সু চির মতোই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।’

নিঃসন্দেহে জাতিগত নিধন—ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল : ব্রিটিশ ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রতিনিধি দলের সদস্যারা বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতন, জাতিগত নিধন, বর্বরোচিত ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন চলছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে সফরে এসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সাত দিনে সফরের শেষ দিনে গতকাল ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ মন্তব্য করেন। তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমপি অ্যান মেইন। এ প্রতিনিধি দলের অন্য দুজন এমপি হলেন পল স্কালি ও উইলকুইন্স। অ্যান মেইন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি মানবসৃষ্ট ট্র্যাজেডি। এটা যে একটি জাতিগত নিধন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ রাখাইনে ‘গণহত্যা’ সংঘটিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণহত্যার সংজ্ঞা আমার জানা নেই। তবে সেখানে যা ঘটেছে তা খুবই ভয়ঙ্কর। আমরা খুবই মর্মাহত, সেখানে বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা জানি না সেখানে কতজনকে খুন করা হয়েছে। তবে যা হয়েছে তা অবশ্যই ভয়ঙ্কর।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে সামর্থ্যানুযায়ী বাংলাদেশ যা করছে তা প্রশংসনীয়।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ চায় সৌদি আরব : রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিত জাতিগতভাবে নিধনযজ্ঞ থামাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্র সৌদি আরব। গতকাল জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনের আগে দেওয়া ভাষণে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। অধিবেশনে সৌদি আরবের পক্ষে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে নিয়োজিত দেশটির দূত আবদুল আজিজ বিন মুহাম্মদ আল-ওয়াসিল।

রাশিয়া ও চীনের সহায়তা ও সমর্থন প্রত্যাশা : উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য রাশিয়ার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী নিউইয়র্কে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে এক বৈঠকে এ সহায়তা কামনা করেন। সূত্রমতে, রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজে বের করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাশিয়া যেন যুক্ত হয়, ঢাকা এই অনুরোধ করেছে। উত্তরে রাশিয়া বলেছে, ‘তারা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তারা বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ রাখবে।’ অন্যদিকে, চীন সফররত আওয়ামী লীগের নেতারা চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলছেন। আজ চীনের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে আবার কথা বলতে পারেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ : মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতন বন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান বন্ধের দাবিতে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জাতিসংঘ দফতরের সামনে মানববন্ধন করেছেন প্রবাসী বাঙালিরা। অস্ট্রিয়াপ্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির উদ্যোগে এ মানববন্ধন হয়। ভিয়েনায় জাতিসংঘ দফতরে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সদর দফতরে সংস্থাটির ৬১তম সাধারণ অধিবেশন ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে। দেশগুলোর ২ হাজারের অধিক প্রতিনিধি এ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন।

 অন্যদিকে, রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধ ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস মিশন, ফ্রান্সের আয়োজনে সম্প্রতি হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নাগরিকরা যোগ দেন। এ ছাড়া ইপিবিএ, শাহজালাল স্পোর্টিং ক্লাব, বিএনপির ফ্রান্স শাখা, স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, শাহজালাল উলামা পরিষদ, বিকশিত নারী সংঘসহ বাংলাদেশি অনেক সংগঠন অংশগ্রহণ করে।

সর্বশেষ খবর