শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ২২

রসের বাঈদানী সিনেমার ফটোতে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনের পতন

মির্জা মেহেদী তমাল

রসের বাঈদানী সিনেমার ফটোতে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনের পতন

ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন দুর্ধর্ষ ডন পুলিশের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সরকারের রেড কার্ডধারী এই ডনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে তোলপাড় চলছে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সরকারি দলের হয়েও সরকারি দলের লোকজনকে একে একে হত্যা করছে। কোমরের দুপাশে বাঁধা হোলস্টারে পিস্তল ঝুলিয়ে ঘুরছে। কখনো মোটরসাইকেল আবার কখনো খোলা জিপে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা। অথচ পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এ নিয়ে পুলিশ চাপের মধ্যে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দফতরে এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক চলছে। বৈঠকের মধ্যে সেদিনের একটি খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ভিতরের বিনোদন পাতায় একটি ছবির দিকে তার চোখ আটকে যায়। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেন ‘রসের বাঈদানী’ সিনেমার মহরতের একটি ছবিতে পরিচিত একজনের মুখ। যাকে নিয়ে পুলিশের এই বৈঠক চলছিল, সেই ডনের ছবি! পুলিশ কর্মকর্তারা পেপারের

পাতায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আরে তাইতো! ঘুম হারাম করা সেই দুর্ধর্ষ ডন! কিন্তু পুলিশ তাকে কীভাবে ধরবে। এ নিয়েতো বৈঠকে কথাবার্তা হচ্ছেই। পুলিশও তাকে ভয়ে ধরত না। কারণ তার দুটি পিস্তল পুলিশের অস্ত্রের আগে চলত। ছবিতে আরও যে কজন রয়েছেন তাদের একজনকে পুলিশ টার্গেট করল। রসের বাঈদানী ছবির প্রযোজককে টার্গেট করে পরিকল্পনা আঁটল। এবার পুলিশের অভিযান সফল হলো। পুলিশ গ্রেফতার করতে সমর্থ হলো সেই ডনকে। স্বস্তি ফিরে আসে পুলিশ প্রশাসন শুধু নয়, সরকারের মধ্যেই। সেই ডন আর কেউ নয়, তিনি হলেন কামাল, গাল কাটা কামাল। ১৯৮২ সালের জানুয়ারির শীতের এক সকালে এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্রেফতার হয় কামাল। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিলেন দুর্ধর্ষ কামাল। এফডিসি থেকে বেরিয়ে ট্রাকস্ট্যান্ড হয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। একে একে ১১টি দেয়াল টপকেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা তাকে পড়তেই হয়েছিল পুলিশের কাছে।

পুরো নাম আবুল হাসনাত কামাল। পুরান ঢাকার একটি বৈঠকে কামালের সঙ্গে হাতাহাতি, পরে ভাঙা বোতলের আঘাত। সেই আঘাতেই কামালের চিবুকে বড় ক্ষতের দাগ। তখন থেকেই তিনি হলেন ‘গাল কাটা’ কামাল। আর এই গাল কাটা কামাল নামটিই হয়ে ওঠে পরবর্তীতে সন্ত্রাসের মূর্তপ্রতীক। ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে কামাল চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার বন্ধু ফজলুর রশিদ ঢালী ছিলেন ‘রসের বাঈদানী’ ছবির প্রযোজক আর কামাল ছিলেন এর প্লেব্যাক সিঙ্গার। রসের বাঈদানী ছবির প্রথম দিনের শুটিংয়ের মহরতের খবর একটি পত্রিকায় গ্রুপ ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ওই ছবিতে কামালও ছিলেন। তখন পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল কামালকে। পত্রিকায় গ্রুপ ছবি দেখে পুলিশ কামালকে গ্রেফতারের সূত্র খুঁজে পায়। ঢালীর মোহাম্মদপুরের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। তাকে জেরা করে পুলিশ। ঢালী স্বীকার করে কামালের কথা। পুলিশ তাকে চাপ দেয়, যেভাবেই হোক কামালকে আসতে হবে অস্ত্র ছাড়া। সেই কৌশলও পুলিশ তাকে শিখিয়ে দেয়। পরদিন যেখানে ঢালীর সঙ্গে দেখা হবে কামালের, সেখানে পুলিশ ওতপেতে থাকে। পরদিন কামাল এফডিসিতে যান। ঢালীর কথা শুনে কামাল তার দুটি অস্ত্র প্রথমবারের মতো বাসায় রেখে আসে। পরে এফডিসি থেকে বেরিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার দিকে রওনা হয় কামাল। সেখানে যাওয়া মাত্র পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় ১১টি দেয়াল টপকান কামাল। কামালের তথ্য মতে পুলিশ ওই সময়ে তার বাসা থেকে দুটি রিভলবার উদ্ধার করে। সে সময়ে যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেন, কামালের সঙ্গে যুবদলের কোনো সম্পর্ক নেই। সামরিক আদালতে জাফর, ফিরোজ ও রানাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলায় ফাঁসির রায় হয়। ১৯৮২ সালে সেই ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। ফাঁসি কার্যকরের আগে কামালের পরিকল্পনা ছিল জেল ভেঙে পালিয়ে যাবে। কিন্তু বিষয়টি গোয়েন্দারা জানতে পেরে এক প্রকার গোপনেই তার ফাঁসি কার্যকর করে। গাল কাটা কামালের অপরাধ জীবন সম্পর্কে জানতে এই প্রতিবেদক কামালের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাদের বক্তব্যে প্রায় ৪০ বছর আগেকার কামালের অপরাধ জীবনের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।

তাদের তথ্য মতে, কামাল গান গাইতেন, শেখাতেনও। যে হাতে তিনি হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন, সেই হাতেই তিনি অস্ত্র চালাতেন। লাশ ফেলতেন। কখনো নিজ প্রয়োজনে, কখনো ভাড়াটে হয়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে গুলি করে খুন করতে যেমন ছিলেন পারদর্শী, তেমনি ধারালো অস্ত্রের ব্যবহারে দেহ থেকে মাথা আলাদা করতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। খুনের নেশায় মত্ত এই মানুষটির ভয়াবহ সব কর্মকাণ্ডে কাঁপত ঢাকা শহর। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো সেই দানবে রূপ নেওয়া গাল কাটা কামালের অপরাধ জীবনের ইতি ঘটে কারাগারের দেয়ালের আড়ালের ফাঁসির দড়িতে। ১৯৭৪ সালে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা কলেজছাত্র কামালের নাম-ডাক খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে।

কামালের ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রগুলো জানায়, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন গাল কাটা কামাল। কখনো মোটরসাইকেলে, কখনো জিপে করে। দাপিয়ে বেড়াতেন ঢাকার এ মাথা থেকে ও মাথা। একাই খুন করতে পছন্দ করতেন তিনি। একে একে খুন করে গেছেন, কিন্তু তাকে খুন করার সাহস দেখায়নি কেউ। যে কারণে ‘খুনের বদলা খুন’— আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই নীতিও ধোপে টিকেনি তার অসীম সাহসিকতার কারণে। এক সময়ে এই গাল কাটা কামালের নাম ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীজুড়ে। পুলিশের খাতায় তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড। এরপরও তিনি কোমরের দুপাশে দুটি পিস্তল গুঁজে বুক চিতিয়ে চলাফেরা করতেন। সরকারের রেড কার্ডধারী এই দুর্ধর্ষ অপরাধী এক সময় হয়ে ওঠেন ‘ঢাকার ডন’। ১৯৭৪ সাল থেকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক গাল কাটা কামালের হাতে একজন এমপি, যুবদলের জাফর, ফিরোজ, রানাসহ অসংখ্য খুনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি এতটাই প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন যে, তার প্রতিপক্ষ সোহরাওয়ার্দী কলেজের দুই ছাত্রনেতার বাসা লক্ষ্য করে প্রতিদিন নিয়ম করে চার রাউন্ড করে গুলি ছুড়তেন। পুলিশ বা অবৈধ অস্ত্রধারী কেউ তাকে এই গুলিবর্ষণ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দিনের কোনো না কোনো এক সময় তিনি নিজেই গুলি করে চলে আসতেন। তাকে ঠেকানোর পরিস্থিতি সে সময়ে কারও ছিল না। ফরিদপুরের করণগোলার কার্তিকপুর কামালের গ্রামের বাড়ি। ঢাকায় এসে প্রথমে মোহাম্মদপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম রোডে খালার বাসায় থাকতেন। পরে গোপীবাগের অভয় দাস লেনে তার বাসা ছিল। বিয়ের পর তিনি গেন্ডারিয়াতেও ছিলেন। কামালের বাবা আবুল হোসেন খান, যিনি প্রথমে পুলিশে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে ব্যবসা ও হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। কামালরা ছিলেন দুই বোন, তিন ভাই। তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ভাইদের মধ্যে বড়। তার পরিবারের সবাই ছিলেন সংগীত শিল্পী। কামাল নিজেও গান গাইতেন, শেখাতেন। চলচ্চিত্রেও তিনি গান গাইতেন।

ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার ফিল্মি স্টাইলে নানা অপারেশনের কারণে। জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয়তাবাদী যুবদল গঠনের পর কামাল যুবদলে যোগদান করেন। তিনি কোতোয়ালি থানা যুবদলের সভাপতি মনোনীত হন। কামালকে রাজনৈতিকভাবে তখন উপরে তোলেন বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন বিএনপির এক নেতা। পল্টনে জাতীয়তাবাদী যুবদল কর্মী ছিলেন জাফর। তিনি ছিলেন অবাঙালি। নয়াপল্টনের জাফর নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এই জাফরের নামডাক ছিল। তৎকালীন মন্ত্রী আবুল কাশেমের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এই জাফর। সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নওয়াবপুর এলাকার জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী ছিলেন ফিরোজ ও রানা। অভয় দাস লেনের প্রামাণিকের সঙ্গে ফিরোজ-রানার গোলমাল হয়। প্রামাণিক ছিলেন কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আপস মীমাংসার কথা বলে যাত্রাবাড়ী থেকে ফিরোজ-রানাকে একটি জিপে তুলে নেন কামাল। তাদের নেওয়া হয় অভয় দাস লেনের শহীদ নবী বিদ্যালয়ের ভিতর। সেখানে ফিরোজ আর রানাকে কামাল জবাই করে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের দেহ আর মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দুজনের খণ্ডিত লাশ আবারও জিপে তুলে নেন কামাল ও তার সহযোগীরা। জগন্নাথ কলেজের ভিতরের একটি মাঠে লাশ ফেলে রাখেন কামাল। এ ঘটনাটি তখন সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে এই জোড়া খুনের ঘটনাই কামালের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়।

সর্বশেষ খবর